রিয়াল মাদ্রিদে দ্বিতীয় মেয়াদে ফেরার পরপরই বলেছিলেন কার্লো আনচেলত্তি, ‘নতুন পুরাতন সবাইকে নিয়েই আমার দল হবে। ৬ বছর আগে যে দল রেখে গিয়েছি, তাঁদের অনেকেই এখনও নিজেদের সেরা ফর্মে, তাদেরকে ছেঁটে ফেলতে আমি আসিনি।’
রিয়াল সমর্থকদের আনচেলত্তিকে নিয়ে সমস্যাটা ছিল সেখানেই। কার্লো আনচেলত্তি কোচ হিসেবে কোনোভাবেই হেলাফেলার পাত্র নন। ইউরোপের টপ ক্লাবগুলোর ডাগ-আউটে বসেছেন তিনি। কিন্তু সমস্যাটা তার নস্টালজিয়ায় ভাসা নিয়ে।
নস্টালজিয়া দিয়ে সুখস্মৃতিতে ভাসা যায়, কিন্তু দিনের পর দিন জয় ছিনিয়ে আনা যায় না। এত বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আনচেলত্তিও সেটা জানতেন। রিয়ালের সাথে ‘লা ডেসিমা’ জয়কে যিনি ধরেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ জয় হিসেবে, তিনি রিয়ালকে অতল পাথারে ফেলে যাবেন না তা নিশ্চিত।
কার্লো আনচেলত্তির রিয়াল নতুন করে শুরু করা এক রিয়াল, নতুন যুগে পা দেওয়া রিয়াল। গ্যালাক্টিকোস এরা থেকে রিয়ালের ডিফেন্স আগলে থাকা সার্জিও রামোসকে ছাড়া শুরু করা মৌসুমে রিয়ালের নতুন যুগের সূচনা। রিয়ালে দ্বিতীয়বারের মতন আগমণটা অন্যরকম একটা পরিস্থিতিতে হয়েছে আনচেলত্তির জন্য। আগের মেয়াদে যখন রিয়ালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন কার্লো, তখন তার হাতে ছিল একগাদা তরুণ খেলোয়াড়। মোরিনহোর হাতেগড়া দলকে শিরোপা জেতাতে কার্লোর প্রয়োজন ছিল শুধু একটুখানি স্পার্ক। আর সেটাই সেই রিয়াল দলে দিতে পেরেছিলেন তিনি।
কিন্তু এবারের রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থা পুরোপুরি উল্টো। এই দলে দেওয়ার মতন খেলোয়াড় অনেক আছেন বটে, কিন্তু অনেকেই পৌছে গিয়েছেন নিজেদের শেষ বয়সে। অধিনায়ক মার্সেলো, ইসকো’ এদের কাছ থেকে পাওয়ার মতন আর কিছুই নেই। মদ্রিচ ৩৬ বছর বয়সে এসেও যে খেলা দেখাচ্ছেন, তা দিয়ে মুগ্ধ হওয়া সম্ভব, কিন্তু তাতে সব ভরসা রাখলে তার একটা চোটই ছিটকে দিবে রিয়ালকে। যেমনটা আনচেলত্তিই দেখেছিলেন ২০১৫ সালে।
রিয়ালের এই দলে প্রয়োজন রিবিল্ডিং, শুরু থেকে আবার ওসবকিছু শুরু করা। কিন্তু কার্লো আনচেলত্তি তার বিশাল কোচিং ক্যারিয়ারে কখনোই এই কাজটায় সফল ছিলেন না। রিয়াল মাদ্রিদে সে বিশাল দায়িত্বই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার কাঁধে।
আর সে দায়িত্বই আনচেলত্তি শুরু করেছেন নতুন-পুরাতনের মিশেলে। আনচেলত্তির অধীনে নিজের সেরা ফর্মে ছিলেন গ্যারেথ বেল। রোনালদোর ছায়ায় করিম বেনজেমাকে অতোটা চোখে পরতো না বটে, কিন্তু রোনালদোর চলে যাওয়ার পর সেই বেনজেমাতেই ভরসা। আর রোনালদোর রেখে যাওয়া ৭ নম্বর জার্সি পাওয়া ইডেন হ্যাজার্ড। অ্যাটাক নিয়ে কোনো দোটানায় ভুগেননি তিনি।
নতুন সাইনিং আলাবাকে স্থান দিয়েছেন লেফট ব্যাকে। বোঝাই যাচ্ছে প্রথম ম্যাচেই নিজের সেরা একাদশকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন। আর ফলটাও পেয়েছেন সেরকম। ৪-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে রিয়াল। কিন্তু বলতে যতটা সহজ, খেলতে ততটা সহজ ছিল না আনচেলত্তির রিয়াল।
হাই লাইন ডিফেন্স আর ডাবল পিভট নিয়ে নামা আলাভেস রিয়ালকে কোনো আক্রমোণের সুযোগই দেয়নি ৩৩ মিনিট পর্যন্ত। প্রথমার্ধে আসেনি কোনো গোল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে নামতে না নামতেই ১৫ মিনিটে তিন গোলের লিড লাভ করে ফেলে রিয়াল। আনচেলত্তির প্রথম মেয়াসে রিয়ালের হয়ে গোলের খাতা খুলেছিলেন এই বেনজেমাই। ৮ বছর পর সেই বেনজেমাই আনচেলত্তির দ্বিতীয় মেয়াদেও খুললেন গোলের খেরোখাতা। গত মৌসুম যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই যে শুরু করেছেন আবার।
এমনকি শেষ মিনিটে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের কাছ থেকেও গোল বের করে এনেছেন আনচেলত্তি। যে ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে রিয়াল সমর্থকদের হতাশা কাটেনি পুরো মৌসুমেও, সেই ভিনিসিয়ুস মাঠে নামতে না নামতেই কারিকুরি দেখিয়েছেন।
আনচেলত্তির কোচিং করানো দলে কোনোদিনও গোলের খরা হয় না। তার কোচিং স্টাইলই এমন যে নিয়মিত হোল আসতে থাকে। কারণ দলের উইঙ্গারদের খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারেন তিনি। এমনকি ডানে-বামে উইঙ্গে সাপোর্ট দেওয়া খেলোয়াড়দেরও বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারেন তিনি।
তৃতীয় গোলে ভালভার্দের দৌড়াটা যেমন, আগের টার্মে ডি মারিয়াকে নিয়ে যেটা করতেন, সেটাই করেছেন ভালভার্দেকে দিয়ে। দ্রুত একটা টান দিয়ে মাঝমাঠ ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন তিনি। সেখান থেকে সহজেই স্কোরলাইন বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন বেনজেমা।
এমনকি যে ভিনিসিয়ুস বল নিয়ে কারিকুরিতে ব্যস্ত থাকতেন বেশিরভাগ সময় তাকেও বলেছেন খেলা দুই টাচে শেষ করতে। কারণ একটাই, গোলমুখে ভিনিসিয়ুসের ড্রিবল থেকে গোল বেশি প্রয়োজন।
মৌসুম শুরু হতে না হতেই রিয়ালে নিজের খেলোয়াড়দের শক্তিমত্তা, দূর্বলতা ধরে ফেলেছেন আনচেলত্তি। প্রথম ম্যাচটাই তার প্রমাণ। ম্যাচ নিশ্চিত হওয়ার পরই তুলে এনেছেন ইনজুরিপ্রবণ হ্যাজার্ড-বেল জুটিতে। ইসকোকে নতুন করে একটা সুযোগ দিয়েছেন কিছু করে দেখানোর, তরুণরাও সময় পেতেছে ভালোই।
কথায় আছে সকালের সূর্য দেখে পুরো দিনের অবস্থা বলে দেওয়া যায়।রিয়ালের এই মৌসুমের ক্ষেত্রে তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না। পুরোটাই নির্ভর করছে আনচেলত্তি দলকে কতটা আগলে রাখতে পারেন এইভাবে শেষ পর্যন্ত। রিয়ালে দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সফল হতে পারবেন তো আনচেলত্তি?