স্থপতি আন্দ্রে পিরলো

সতীর্থরা তাঁকে ডাকত আর্কিটেক্ট নামে। স্থপতি যেমন একটি দালানের মূল ভিত গড়ে দেন সামনে থেকে তেমনি তিনি দলকে নেতৃত্ব দিতেন অগ্রনায়ক রূপে। বল দখলের অসাধারণ দক্ষতা, গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, খেলাকে সুন্দর করে সাজানোর সক্ষমতায় তাকে স্থপতি বলতে বাধ্য যে কেউ। মধ্যমাঠ শাসন করে গেছেন নিরবে নিভৃতে। সাবেক ক্লাব জুভেন্টাসের সমর্থকরা ডাকত প্রফেসর বলে। ঝাঁকড়া চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে তিনি প্রফেসরের আদর্শ প্রতিরূপ। কেউ নাম দিয়েছে মায়েস্ত্রো! ইতালির সাবেক গুরু মার্সেলো লিপ্পি সাধে বলেননি, ‘পিরলো একজন শান্তশিষ্ট নেতা যিনি কথা বলেন পায়ের সাহায্যে!’

ফুটবলে ‘একুশ’ এর তেমন মাহাত্ম্য নেই। কিন্তু ইতালিয়ানদের কাছে একুশ নম্বর বিশেষ কিছু। স্বভাবতই ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্তাসের কাছেও! একুশ চাপিয়ে এক সময় মাঠে নামতেন পিরলো। নিজের সাথে যিনি কিংবদন্তি বানিয়ে দিয়েছেন সংখ্যাটাকে।

সতীর্থরা তাঁকে ডাকত আর্কিটেক্ট নামে। স্থপতি যেমন একটি দালানের মূল ভিত গড়ে দেন সামনে থেকে তেমনি তিনি দলকে নেতৃত্ব দিতেন অগ্রনায়ক রূপে। বল দখলের অসাধারণ দক্ষতা, গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, খেলাকে সুন্দর করে সাজানোর সক্ষমতায় তাকে স্থপতি বলতে বাধ্য যে কেউ। মধ্যমাঠ শাসন করে গেছেন নিরবে নিভৃতে। সাবেক ক্লাব জুভেন্টাসের সমর্থকরা ডাকত প্রফেসর বলে। ঝাঁকড়া চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে তিনি প্রফেসরের আদর্শ প্রতিরূপ। কেউ নাম দিয়েছে মায়েস্ত্রো! ইতালির সাবেক গুরু মার্সেলো লিপ্পি সাধে বলেননি, ‘পিরলো একজন শান্তশিষ্ট নেতা যিনি কথা বলেন পায়ের সাহায্যে!’

গোলের খেলায় গোলই ধ্যানজ্ঞান। একটা গোল বদলে দেয় দৃশ্যপট। লোকের মুখে মুখে গোলদাতার গল্প ফেরে। যারা ফুটবলের কট্টরভক্ত তারা আলাদা। তাদের নজর থাকে অন্যত্র। মাঠে কয়েকজন থাকেন যারা আড়াল থেকে গোটা খেলার চিত্রনাট্য রচেন। তাদের একজন ইতালির ফ্লেরোতে ১৯৭৯ সালের ১৯ মে জন্ম নেওয়া পিরলো, আন্দ্রে পিরলো।

ফুটবলীয় মাধুর্যে তিনি মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। বছর চারেক আগে ৩৬ বছরের বুড়ো পিরলোকে রেকর্ড বেতনে দলে ভেঁড়াতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি আমেরিকান সকারের ক্লাব নিউইয়র্ক সিটি। ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে হয়েছিলেন দলের ভরসা। সহজাত প্রতিভাধর পিরলোর ফুটবল ক্যারিয়ারের আগাগোড়া সাফল্যে মোড়ানো। ফুটবলে লাথি মারার শুরু স্থানীয় ক্লাব ব্রেসকিয়ার যুবদলে ১৯৯৪ সালে। পরের বছর যোগ দেন মূল দলে। ছিলেন ১৯৯৮ পর্যন্ত।

কুঁড়িতে পা দেওয়া পিরলোর মেধা আর সৃজনশীলতার চমৎকার প্রয়োগ নজর কাড়ে সকলের। আটানব্বইয়ে তাকে দলে নেয় জায়ান্ট ইন্টার মিলান। খেলিয়েছিল মাত্র এক মৌসুম। ক্যারিয়ার ধ্বংস করেনি ইন্টার বরং রেগিনা আর পুরনো ক্লাব ব্রেসকিয়ায় লোনে পাঠিয়ে শানিত করে এই ব্রক্ষ্মাস্ত্রকে, বিশ্ব পায় পোঁড় খাওয়া এক শিল্পীর সন্ধান। তাকে নিয়ে ইন্টারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বৃথা যায়নি। প্রমাণ দিয়েছেন এক মৌসুমে ২২ ম্যাচে আট অ্যাসিস্ট করে। বুঝিয়ে দিয়েছেন যতদিন থাকবেন সবুজ ক্ষেত্রে ততদিন শাসন করবেন মধ্যমাঠ।

মধ্যমাঠের রাজাকে ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষদিনে তৎকালীন ইতালিয়ান রেকর্ড দামে নিজেদের করে নেয় ইন্টারের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মিলান শহরের আরেক দল অ্যাতলেটিক ক্লাব মিলান। সময় তখন ২০০১, বয়স মাত্র বাইশ। ছোট বয়সে বড় ক্লাবে গিয়ে খেই হারাননি। ফুটেছেন কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে। বারো বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ মিডফিল্ডের আরেক কিংবদন্তী রবার্তো ব্যাজ্জিওর সাথে মিলে কয়েকটা বছর সদম্ভ বিচরণ করেছেন ফুটবল মাঠে।

মাঝমাঠকে বানিয়ে ফেলেছেন নিজস্ব সম্পত্তি। নিজের চেয়ে বয়সে ছোট হলেও দক্ষতায় এগিয়ে ছিল পিরলো, তা অকপটে মেনে নিয়েছেন রবার্তো। প্রশংসা বাণীতে বলতে ভুলেননি, ‘ও পুরোপুরিভাবে তার মেধা এবং যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েছে। আমরা যখন একসাথে খেলতাম তখন সবকিছু ওর কাছ থেকে শুরু হত!’

মিলানের হয়ে জিতেছেন সম্ভাব্য সবকিছু। ইতালিয়ান ফুটবলের দেবতূল্য মহাতারাকে মিডফিল্ড শ্রেষ্ঠত্বের রাজদণ্ড সতীর্থরা দিয়েছে বহু আগে! ২০১১ সালে যখন নিশ্চিত হয় জুভেন্তাস গমন, তা শুনে জিয়ানলুইজি বুফন বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় এটা জুভেন্তাসের শতাব্দী সেরা সাইনিং! পিরলোর যোগ্যতা, দক্ষতা সবই ঈশ্বর প্রদত্ত যা কোন কিছু দিয়ে মাপা অসম্ভব।’

জুভদের ডোরাকাটা সাদাকালোতে ছিলেন চার বছর। বিধাতা সেখানে তাকে দিয়েছে দুই হাত ভরে। এর আগে সোনায় মোড়ানো দশটি বছর কাটে মিলানে, ক্যারিয়ারের মধ্যগগনের প্রতি মূহুর্ত ঢেকেছিল লাল কালো রঙে। ২০০১-২০১১, নি:সন্দেহে দীর্ঘযাত্রা। শুধু ফ্রি কিক পাওয়ারে পিরলোর কাছে নতজানু হবে কতজন।

পিরলোরা আনসাং হিরো, পর্দার আড়ালে থেকে রণকৌশলের প্রয়োগ ঘটান। খালি চোখে দেখা যাবে না তাদের বিজয় তিলক, হাতের রাজটিকা। তবু তারা মহীরুহ, ফুটবলাকাশে চিরস্থায়ী নক্ষত্র। এমনি এমনিই তো আর ইতালির হয়ে মাঠে নামেননি ১১৬ ম্যাচ, প্রতিনিধিত্বের বিচারে আজ্জুরিদের নীলজামায় যা চতুর্থ সর্বোচ্চ!

দেশের জন্য অবদান জানাতে ছোট একটি তথ্য যথেষ্ট। ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় তিনি। শুধু তাই নয়, টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের যোগানদাতার নাম পিরলো। শেষ ক্লাব নিউইয়র্কের ফুটবলার মাইকেল কক্সের তাকে নিয়ে করা মন্তব্যের সারমেয় এমন, ‘পিরলো হয়ত তার প্রজন্মের অবিসংবাদিত সেরা নয় কিন্তু অবশ্যই মহাগুরুত্বপূর্ণ একজন।’ ২০১৩ সালে নিজের আত্নজীবনী লিখেছেন ‘আই থিংক, আই দেয়ারফর প্লে’ নামে।

সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ারে অর্জনের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বকাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা উঁচিয়ে ধরা বিরল তারকাদের একজন তিনি। পুরো জীবনে একটি পেলে যেখানে বর্তে যায় অনেকে সেখানে পরপর দুই বছর চুমু এঁকেছেন স্বপ্নের বিশ্বকাপের সোনালি গোলক আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রূপালি পাতে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...