১৯৭৮, সামরিক শাসন ও আর্জেন্টিনার কলঙ্ক

বেশ কয়েক দফা চেষ্টা আর বয়কটের পর ১৯৬৬ সালের ফিফা কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হল। ঠিক করা হয় ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হবে আর্জেন্টিনাতেই।

কে জানত, সেটাই হবে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময় – সবচেয়ে কুখ্যাত ও সমালোচিত বিশ্বকাপ!

সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরনের মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি নির্ধারণ করা হয়েছিল বিশ্বকাপের লোগো হিসেবে, যা পরবর্তীতে সমালোচনা ছড়িয়েছিল বিস্তর। কেবল মাঠের বাইরে নয় মাঠের খেলাতেও স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ছিল পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।

ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, উরুগুয়ের মত শক্তিশালী দলগুলো বাদ পড়েছিল বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব থেকেই। অন্যদিকে, ইরান এবং তিউনিশিয়া বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছিল প্রথম বারের মত।

ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ পুরো বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব জুড়ে ছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর তিন মাস আগে তাঁর পরিবারকে অপহরণের হুমকি দেয়া হয়।

ফলে, সেই বিশ্বকাপে খেলতে আসেননি ক্রুইফ। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানির জয়ের নায়ক জার্ড মুলারও ততদিনে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তার হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে বিশ্বকাপে আসেননি আরেক জার্মান তারকা পল ব্রেইটনারও।

প্রথম ম্যাচ থেকেই অদ্ভুতভাবে রেফারির সব সিদ্ধান্ত আর্জেন্টিনার পক্ষে যাচ্ছিল। তাছাড়া বাকি সব দলের খেলা দুপুরে হলেও স্বাগতিকদের খেলা রাখা হয়েছিল সন্ধ্যায়।

যাতে করে বাকিদের খেলার ফলাফল দেখে মাঠে নামতে পারেন তাঁরা। হাঙ্গেরির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ শেষে তাঁদের কোচ লাজোস বারোতি বলেছিলেন, ‘এখানকার সব কিছু আর্জেন্টিনার পক্ষে, এমনকি বাতাসও।’

ফ্রান্সের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও অব্যাহত থাকে বাজে রেফারিংয়ের ধারা। প্রথমার্ধেই নিশ্চিত এক পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত হয় ফ্রান্স। অথচ অপরপ্রান্তে বিতর্কিত এক পেনাল্টির বাঁশি বাজান স্বাগতিকদের হয়ে।

পক্ষপাতদুষ্ট রেফারিং আর সতীর্থদের বাজে মিসের কারণে একা মিশেল প্লাতিনি সেদিন জেতাতে পারেননি ফরাসিদের, ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় স্বাগতিকরা। মিশেল প্লাতিনির ক্যারিয়ারে কখনওই বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। অথচ, ওই সময়টায় বিশ্বের অন্যতম সেরা ছিলেন।

দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার ম্যাচ সমতায় শেষ হওয়ায় শেষ ম্যাচটা হয়ে দাঁড়ায় অঘোষিত ফাইনাল। আর সেখানেই জন্ম নেয় ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিতর্ক।

শেষ ম্যাচে ব্রাজিল ৩-১ গোলে পোল্যান্ডকে হারায়। আর্জেন্টিনার সামনে তখন প্রায় অসম্ভব এক সমীকরণ দাঁড়ায় – পেরুকে হারাতে হবে ৬-০ ব্যবধানে। এখান থেকেই বিশ্বকাপের মূল কলঙ্কের সূত্রপাত।

সেই সময়টাতে পেরু শক্তিশালী দল না হলেও ছয় গোল খাওয়ার মত দল ছিল না। প্রথমার্ধে খানিকটা লড়াই করলেও দ্বিতীয়ার্ধে যেন কেবল মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন পেরুর ফুটবলাররা, আর আর্জেন্টাইনরা গোলের পর গোল করে গেছেন। ৬-০ গোলের জয় পেলেও তা জন্ম দেয় নানা বিতর্কের।

শোনা যায় ম্যাচের হাফ টাইমে পেরুর ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন স্বৈরশাসক জেনারেল ভিদেলা, হুমকি দেন ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার। এছাড়া সংবাদমাধ্যমে পরে খবর বেরিয়েছিল ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে পেরুকে অস্ত্র এবং খাদ্য সহায়তা পাঠিয়েছিল আর্জেন্টিনা।

টানা দ্বিতীয় বারের মত ফাইনালে উঠেছিল নেদারল্যান্ডস, যেখানে তাঁদের প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিকরা। ফাইনালের আগেই শুরু হয়ে যায় স্বাগতিকদের কারিশমা, ডাচদের বহু পথ ঘুরিয়ে ক্লান্ত করে নিয়ে আসা হয় স্টেডিয়ামে।

ম্যাচের পাঁচ মিনিট আগে বদলে ফেলা হয় রেফারি। মারিও কেম্পেস শুরুতে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিলেও ম্যাচের শেষভাগে দিক নানিজ্ঞার গোলে সমতায় ফেরে ডাচরা, ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

তবে সেখানে আর পেরে ওঠেনি ক্রুইফবিহীন নেদারল্যান্ডস, কেম্পেসের দ্বিতীয় আর ড্যানিয়েল বারোনির গোলে ৩-১ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় স্বাগতিকরা। ম্যাচ শেষে রাগে ক্ষোভে ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেয়নি ডাচরা। তাই বিশ্বকাপ জয়েও লেগেছিল কালিমায় দাগ, শত চেষ্টাতেও যা দূর করতে পারবে না আর্জেন্টিনা।

কেউ কেউ সেটাকে মারিও কেম্পেসের বিশ্বকাপ বলেন, কারও কাছে সেটা আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ। কিন্তু, ফুটবলের চোখে সেটা কেবলই এক কলঙ্কের অধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link