১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কিথ মিলার বোর্নমাউথে ছিলেন। ফুর্তিবাজ মিলার এবং সেনাবাহিনীতে তাঁর বন্ধুদের প্রতি শুক্রবার রাতে পাবে যাওয়াটা একটা অভ্যাসের মত ছিল। এরকমই এক শুক্রবার, মিলার ঠিক সময় গন্তব্যে পৌঁছতে পারেননি। যখন পৌঁছলেন, দেখলেন জার্মান বোমারু বিমান আক্রমণ করেছে বোর্নমাউথ এবং তাঁর বন্ধুরা সকলেই মারা গেছেন।
আরেক বার নরফোকে বিমান ল্যান্ড করতে গিয়ে দারুণ বিপদের মুখ থেকে বেঁচে ফেরেন মিলার। তা এই মিলারকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটের চাপ কেমন?’ মিলারের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘ধুর, এটা কোনো চাপ হল? আসল চাপ তো তখনই টের পেতাম যখন যুদ্ধের সময় জার্মান বোমারু বিমান আমাকে ধাওয়া করে আসতো।’
১৯১৯ সালে স্মিথ ভাতৃদ্বয়-কিথ এবং রস, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ডে বিমান উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। সেই বছরই ২৮ নভেম্বর জন্মান মিলার। স্মিথ ভাতৃদ্বয়ের নামেই তাঁর নাম রাখা হয়, কিথ রস মিলার। ডেনিস কম্পটন এবং তিনি, কিথ মিলার-এই দুজনেই ছিলেন পরম বন্ধু এবং টেস্ট ক্রিকেটে তরতাজা জীবনের নির্যাস।
ব্র্যাডম্যানের মত যান্ত্রিক ক্রিকেট নয়, মিলার খেলতেন নিজের এবং দর্শকের মন খুশি করা ক্রিকেট। আর যেহেতু মৃত্যুকে এত কাছ থেকে এতবার তিনি দেখেছেন, তাই ক্রিকেটের বাইরেও যে একটা জীবন আছে বিরাট বড়, সেটা তিনি বুঝতেন। এসেক্সের সাথে যেবার অস্ট্রেলিয়া একদিনে ৭২১ তুললো (ব্র্যাডম্যানের অপরাজেয় সফর-১৯৪৮), সেবার মিলার ব্যাট করতে নেমেই লেগের দিকে সরে গিয়ে, নিজে থেকে আউট হয়ে বেরিয়ে আসেন।
মিলার প্রথম বিশ্ব ক্রিকেটে নজরে আসেন ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ পরবর্তী বেসরকারি লর্ডস ‘ভিক্টরি’ টেস্টে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে করেন ১৮৫, যার মধ্যে ছিল এরিক হোলিস কে মারা সাতটি ছক্কা, যার একটা আবার লর্ডস পার করে যায়। এরপর সেই একই মরসুমে লিন্ডসে হাসেটের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলীয় সার্ভিসেস দল ভারত সফর করে।
সেই সফরের দ্বিতীয় ‘টেস্ট’ হয় ইডেনে। সেই ম্যাচে ব্যাটসম্যান মিলার এক অনুপম ৮২ করেন, যার মধ্যে ছিল ভিনু মানকারকে মারা ৫ বলে ৪ টি ছক্কা। যেসব বয়োজ্যেষ্ঠরা সেই ম্যাচ দেখেছেন, তাঁরা এখনো ইডেনে মিলারের সেই ইনিংস নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে তিনি টেস্ট মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন।
মূলত ব্যাটসম্যান হিসেবেই তিনি নজরে আসেন, কিন্তু বোলার মিলারও কম যান না। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে যখন তিনি খেলা শুরু করেন, মূলত একজন বোলিং অলরাউন্ডারের খোঁজেই ছিল অস্ট্রেলিয়া। মিলার এবং লিন্ডবাল-এই জুড়ি একসাথে বহুবার ব্যাটসম্যান শিকার করে বেরিয়েছে। বেশ ছোট্ট রান-আপ থেকেও ভয়ঙ্কর পেস সৃষ্টি করার ক্ষমতা ছিল মিলারের।
১৯৫৩ সালে মিলার লর্ডসে টেস্ট সেঞ্চুরি করেন। এর তিন বছর পর, ১৯৫৬ সালে, লেকার খ্যাত সিরিজে অস্ট্রেলিয়া জয় পায় একমাত্র লর্ডসে-সৌজন্যে মিলার। লিন্ডবালের অনুপস্থিতিতে মিলার সেই টেস্টে একাই ১০ উইকেট তুলে নেন, এবং দুই ইনিংস মিলিয়ে প্রায় ৭০ ওভার বল করেন। মনে রাখতে হবে মিলার তখন ৩৭ এবং সেই বছরেই তিনি অবসর নেন।
এই প্রদর্শনের ফলে, সোবার্স এবং মানকড বাদে মিলারই হয়ে ওঠেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি লর্ডসের ব্যাটিং এবং বোলিং দুই অনার্স বোর্ডেই জায়গা করে নিয়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে একটু খামখেয়ালি হলেও, এমনিতে দারুন বুদ্ধিমান অধিনায়ক ছিলেন। দীর্ঘদিন নিউ সাউথ ওয়েলসের অধিনায়ক ছিলেন তিনি।
কিন্তু, ব্র্যাডম্যানের অপছন্দের পাত্র হওয়ায়, কোনোদিন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হতে পারেননি। অনেকের মতে, ওয়ার্ন নন, মিলারই হলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক না হওয়া সেরা অধিনায়ক।
মিলার পাশ্চাত্য ‘ক্লাসিকাল’ সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে নেভিল কার্ডাসের সাথে তাঁর দারুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কার্ডাস মিলার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ান।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক, জন গডার্ড, মিলারের সম্পর্কে বলেছেন, ‘ও আমাদের দলে থাকলে আমরা আরামসে বিশ্বজয়ী হতে পারতাম।’
শেষ করবো মিলার সম্পর্কে দুটো ঘটনা বলে, তাহলে পাঠক আরেকটু ভাল ভাবে বুঝবেন ঠিক কেমন মানুষ ছিলেন মিলার। একবার নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে খেলার সময় অধিনায়ক মিলার দ্বাদশ ব্যক্তি বাছতে ভুলে যান। মাঠে নেমে আবিষ্কার করেন, ১১ জনের জায়গায় ১২ জন নেমে পড়েছে। মিলার এদিক ওদিক দেখে শান্ত ভাবে বলেন, ‘কি আর হবে? তোদের মধ্যে একজন বসে যা।’
১৯৫৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ সফরের সময়, রাজকন্যা মার্গারেটের সাথে মিলারের সম্পর্ক নিয়ে বেশ কানাঘুষো শোনা যায়। তা হাসেটের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলীয় দল গেছে বাকিংহামে নৈশভোজে। বাস থেকে নেমেই, সকলে যে দরজা দিয়ে ঢুকছেন, তার উল্টো দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন মিলার। হাসেট জিজ্ঞেস করেন, ‘অ্যাই ছোকরা, কোনদিকে যাচ্ছো?’ মিলারের জবাব, ‘আপনারা এগোন। এখানে ঢোকার অন্য অনেক রাস্তাই আমার জানা।’