মুসোলিনি ও অস্ট্রিয়ার কষ্ট ১৯৩৪

১.

১৯৩৯ সাল। ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই গোলাবারুদের মতো আছড়ে পড়ছে দিল্লীর দরবারে। ঝলসে ওঠা তরবারির মতো ভারতের রাজনীতির মানচিত্রে আগমন ঘটেছে সুভাষচন্দ্র বসুর, যিনি ঐ বছর কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশনে পরপর দু’বার নির্বাচিত সভাপতি।

এ হেন যুদ্ধং দেহী মেজাজে যখন তৃতীয় বিশ্ব, তখন চুপিসাড়ে প্রথম বিশ্বের একটি দেশে হঠাৎই আবিস্কার হয় একটি মৃতদেহ। গুস্তাভ হার্টম্যান অস্ট্রিয়ার একটি অ্যাপার্টমেন্টের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েন তাঁর পুরোনো বন্ধুর খোঁজে। আর ঢুকেই চোখে পড়ে, খাটে পড়ে রয়েছে সেই বন্ধুটির এবং তার বান্ধবীর নগ্ন, প্রাণহীন দেহ। পরেরদিন প্রত্যেকটি দৈনিকের হেডলাইন – পেপারম্যান ম্যাথিয়স সিন্ডেলারের অস্বাভাবিক মৃত্যু।

পুলিশি ময়নাতদন্ত থেকে উঠে আসে, ঘরের চিমনির ধোঁয়ায় দম আটকে মৃত্যু। বলাই বাহুল্য, অস্ট্রিয়াবাসীরা এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেনি। জার্মানি অস্ট্রিয়া দখল করার পর সে দেশের সেরা ফরোয়ার্ড ম্যাথিয়স সিন্ডেলার জার্মানির হয়ে খেলতে আপত্তি জানান। এমনকি, একটি প্রীতি ম্যাচে নাৎসিদের বিরুদ্ধে গোল করার পর প্রদর্শিত হয়েছিল তাঁর উল্লাস। নাৎসিদের কাছে যা একেবারেই দৃষ্টিকটু।

সন্দেহের দানা সেখান থেকেই বাঁধতে শুরু করে। অথচ, তার পাঁচ বছর আগেও এই ম্যাথিয়স সিন্ডেলারকে কেন্দ্র করেই ফুটবলের আকাশে নব উত্থান ঘটেছিল অস্ট্রিয়ার। বলা যেতে পারে অস্ট্রিয়ান ফুটবলে নবজাগরণ। যার মূল কেন্দ্রে ছিলেন ম্যাথিয়স সিন্ডেলার এবং আরও একজন, হুগো মেইস।

২.

ভদ্রলোকের পোশাকি নাম ভিত্তোরিও পোজো। এক ফুটবল পাগল। ইতালি দেশটার বহু শহরে ঘোরেন এবং সংগ্রহ করে আনেন মণিমাণিক্য। মণি বলতে ফুটবলার এবং মাণিক্য বলতে ট্যাকটিক্স। ম্যাচ রিডিং ক্ষমতা তুলনাহীন, ফলে ছক কষার সমস্ত প্রস্তুতি হয়ে যায় মাঠে বসেই, খেলা চলাকালীনই।

এ হেন ফুটবলমস্তিষ্কটিকে ব্যবহার করার যাবতীয় আয়োজন করতে শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন তৎকালীন ইতালির একচ্ছত্র অধিপতি, ‘ডিউস’ বেনিটো মুসোলিনি। ভিত্তোরিও পোজো নিজেও ছিলেন চরম ফ্যাসিজম ভক্ত, সর্বোপরি মুসোলিনির সমর্থক। ভালবাসায় বিগলিত করুণা হয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন মুসোলিনির ডান হাত। আর ইতালির জাতীয় দলের কোচ হয়েই ঘোষণা করলেন, ‘সব ভুলে শুধু ইতালির জন্য প্রাণমন উৎসর্গ করতে চলে এসো।’

এই বিবৃতি শুধু যে ক্লাব ফুটবলে ইতালিয় ফুটবলারদের রেষারেষি থামানোর জন্য তা নয়, বহু ইতালিয় বংশোদ্ভূত আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের জন্যও ছিল। যার প্রথমেই ছিলেন লুইসিটো মন্টি, হেনরিক গাইটাও এবং রাইমুন্ডো ওরসি। এদের তিনজনেই আগের বিশ্বকাপে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার হয়ে ফাইনাল খেলেছিলেন।

এবার পোজোর ডাকে চলে এলেন ইতালিতে। পোজো একটা অদ্ভুত কম্বিনেশন ফিট করেছিলেন। ২-৩-৫। অর্থাৎ পাঁচজন খেলবে ওপরে, দু’জন থাকবে নিচে। মারাত্মক অ্যাটাক নির্ভর ছক। কাজও হল তাতে। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে সব দলকে হেলায় উড়িয়ে দিল পোজোর আজ্জুরি দল।

ওদিকে উল্কার ন্যায় উত্থান ঘটছে অস্ট্রিয়ার। আর সেইসঙ্গে প্রথম বিশ্বের মানচিত্রে ঘটে যাচ্ছে পট পরিবর্তন। জার্মানিতে রাজ্যপাট গুছিয়ে বসছেন ‘ফ্যুয়েরার’ হিটলার। মুসোলিনির ইতালি গ্রহণ করেছে আগ্রাসী নীতি, তার ফলে ঘটেছে আবিসিনিয়ার যুদ্ধ।

আবার নিজ ক্ষমতা প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় মঞ্চ তিনি বেছে নিলেন বিশ্বকাপটাই। নিজের দেশেই আয়োজন করলেন বিশ্বকাপ। তার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের করায়ত্ত করে বোঝালেন ইতালি ফ্যালনা নয়! পরে আক্ষেপের সুরে তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে বলেছিলেন, ‘ঐ বিশ্বকাপে আমি কার্যত আয়োজক ছিলামই না!’

৩.

অস্ট্রিয়ার ফুটবলে এই নতুন সূর্যোদয়ের পেছনে যে মানুষটির ভূমিকা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি হুগো মেইস। এই ভদ্রলোক সরকারী চাকরি ছেড়ে হয়েছিলেন রেফারি, সেখান থেকে অ্যাসিস্টেন্ট কোচ হয়ে তারপর সরাসরি অস্ট্রিয়ার জাতীয় দলের দায়িত্ব। হুগো মেইসের ফুটবলটা খেলানোর ধরণ ছিল অনেকটা হ্যামলিনের বাঁশি বাজানোর মতো। সুরেলা, চোখের আরামের ফুটবল।

আলতো পাসের ছোঁয়া, ড্রিবল খুব বেশি নয়, মূলত পাসিং গেম খেলেই বিপক্ষের বক্সে ঢুকে দুম করে গোলটা করে আসা। যে কাজটা পরবর্তীতে আমরা করতে দেখবে ১৯৭৪ এর নেদারল্যান্ডস এবং ২০১০ এর স্পেনকে। একেবারে তিকিতাকা ফর্মেশন না হলেও পাসিং গেমের সেই শুরুটা করে দিয়েছিলেন হুগো মেইস। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছিল জোসেফ স্মিস্টিক, জোসেফ বিকান, অ্যান্টন শার্ল এবং ম্যাথিয়স সিন্ডেলাররা।

তাদের অসামান্য ফুটবল প্রদর্শনের সামনে ইউরোপের দলগুলি মাথা নোয়াতে শুরু করল। বাছাই পর্বে দুর্দান্ত খেলে সহজেই বিশ্বকাপের মূলপর্বে চলে এল তারা। তুরিনের মাঠে ফ্রান্সকে হারিয়ে অস্ট্রিয়া শুরু করেছিল বিশ্বকাপে জয়যাত্রা। কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা মিলল হাঙ্গেরির সাথে। অস্ট্রিয়ান শিল্পের কাছে প্রবল লড়াই করা হাঙ্গেরি ছিটকে গেল ২-১ গোলে। সেমিফাইনালে উঠল অস্ট্রিয়া। এবার তাদের প্রতিপক্ষ ইতালি! স্থান, মিলানের সান সিরো।

সেদিন মিলানে বৃষ্টির বহর দেখে কে! এই বৃষ্টিই ডেকে আনে অসংখ্য কবিতার সমাহার। প্রেমের গান, শিল্প ফুটিয়ে তুলে শিল্পীর মনস্কামনা পূর্ণলাভ করে। কিন্তু ১৯৩৪ সালের তিন জুনের বৃষ্টি সেদিন মিলানের মাঠকে উপহার দিয়েছিল একরাশ কাদা! সে কাদার আটকে গেল মেইসের টিমের সুরেলা ছন্দ। ইতালির আগুনে আক্রমণের কাছে দিশাহারা হল অস্ট্রিয়ার হ্যামলিনের বাঁশিগুলো।

১-০ গোলে হেরে যাওয়া অস্ট্রিয়ার দামালগুলো সেদিন পারফর্মই করতে পারল না। ছন্দভরা পাসগুলো হল মিসপাস, সর্বোপরি হোল্ডিং আর রিসিভিংয়ে গণ্ডগোল দেখা দিল। ইতালির আগ্রাসী নীতির কাছে ছত্রভঙ্গ অস্ট্রিয়ার কাব্য। যদিও রেফারিং নিয়ে বহু কথা উঠেছিল। গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে রেফারিং নিয়ে যে ভাষাটা উঠেছিল তার ইংরেজি তর্জমা করলে মানে হয় – বায়াসড রেফারিং।

বহু তীব্র নিন্দনীয় চ্যালেঞ্জ রেফারি দেখেও দেখেননি। এর পেছনে বলাই যায়, হাত ছিল মুসোলিনির। অস্ট্রিয়াও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারল না সেই হারের পর। তৃতীয় স্থানের খেলায় জার্মানির কাছেও হারল। সেই শেষের শুরু, এরপর অস্ট্রিয়ান ফুটবলে ঐ সোনালী দিন আর ফেরেনি। তার বছর কয়েক বাদেই ভিয়েনার হোটেলে মিলল ম্যাথিউস সিন্ডেলারের নগ্ন মৃতদেহ।

সুমনের গানের মতোই সত্যি। একটুর জন্য কত কিছু হয়নি। ১৯৫৪’র হাঙ্গেরি, ১৯৭৪’র নেদারল্যান্ডস, ৮২-৮৬’র ব্রাজিল, ২০০২’র দক্ষিণ কোরিয়া অথবা ২০১৮’র ক্রোয়েশিয়া। সবাই একটুর জন্য হেরে গেছে। ভাগ্যের কাছে, কপালের ফেরে। ১৯৩৪ বিশ্বকাপ আসলে ইতালিকে যেনতেন প্রকারেণ নিজের দেশের মাটিতে ‘ডিউস’ মুসোলিনির হস্তক্ষেপে পাইয়ে দেওয়ার বিশ্বকাপ।

সেখানে একমাত্র হুগো মেইসের অস্ট্রিয়া শুনিয়ে গিয়েছিল মেঠো পথের গান। ইতিহাস পরাজিতদের গল্প লেখে সবার আড়ালে, রাতের গোপনে। অস্ট্রিয়ার এই টিমটার গল্পও সেভাবেই লেখা, যাদেরকে আখ্যা দেওয়া হতো ‘উন্ডারটিম’ নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সবচেয়ে বেশিবার টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার কারণেই এই নাম। যারা ইতিহাসের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়েও ইতিহাস লিখতে পারেনি, শুধু এক অত্যাচারিত সম্রাটের ফ্যাসিজমকে অগ্রাহ্য করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link