তিন নম্বরের চিরায়ত সমস্যা ও বাংলাদেশ

সৌম্য সরকারকে নিয়ে পুরোপুরি বিপরীত দুইটি সিদ্ধান্ত কাজ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

ক্রিকেটে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট মনে করে বাংলাদেশের অনেক ব্যাটিং সমস্যার সমাধান হলো সৌম্য সরকার। এই কারণেই নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম দুই ওয়ানডেতে তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাট করতে পাঠানো হয়েছে তাকে। তিনি এই পজিশনে ব্যাট করেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্তর জায়গায়।

নাজমুল হোসেন শান্তকে বেশ কয়েক বছর ধরে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। আর বেশ কয়েকটি সিরিজে তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাটিং করছিলেন তিনি। কিন্তু সফল হননি। সর্বশেষ ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেও ব্যর্থ ছিলেন তিনি। তিন ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ৩৮ রান।

তাই নিউজিল্যান্ড সিরিজে শান্তর পরিবর্তে নেমেছিলেন সৌম্য সরকার। কিন্তু প্রথম ম্যাচে মাত্র তিন বল খেলেই প্যাভিলিয়নে ফেরেন সৌম্য। আর আউট হবার ধরণটাও ছিলো বেশ দৃষ্টিকটু। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে কিছুটা ঘুরে দাড়িয়েছেন সৌম্য সরকার।

এই একটি ধারণা হলো সৌম্য সরকারকে নিয়ে। তাকে নিয়ে আরেক পক্ষে ধারণা, সৌম্য প্রচুর সুযোগ পেয়েছেন জাতীয় দলে নিজের অবস্থান পাকা করার জন্য। বিশেষ করে সর্বশেষ ১৮ মাসে তিনি পারফর্ম না করার পরেও দলে সুযোগ পেয়েছেন।

২০১৮ সালে জাতীয় দলে ওপেনার হিসেবে জায়গা হারানোর পর এশিয়া কাপের মাঝখানে তাকে আবার জাতীয় নিয়ে আসা হয়েছিলো মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেব। আবার ২০১৯ সালে ঢাকাতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের প্রথম ইনিংসে ওপেন করেছিলেন সৌম্য। আবার একই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে আট নাম্বার পজিশনে ব্যাট করেছিলেন সৌম্য সরকার।

এর কিছুদিন পরে টিম ম্যানেজমেন্ট জানায়, সৌম্য টি-টোয়েন্টিতে একজন ফিনিশার হিসেবে খেলবেন। এরপর বেশ কিছু ম্যাচে ওই জায়গায় বেশ ভালো পারফর্ম করেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দ্বিতীয় টেস্টের আগে হটাৎ করে দলে ডাক পান সৌম্য সরকার। যেটা বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলো। সাকিবের ইনজুরির কারণে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ায় বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো। কারণ দলে সাইফ হাসানের মত একজন টেস্ট ওপেনার ব্যাটসম্যান ছিলো। তা সত্ত্বেও দলে হঠাৎ করে নিয়ে এসে ওপেনিং করানো হয় তাকে দিয়ে। আর এই ম্যাচে তিনি দুই ইনিংসে করেন মাত্র ০ এবং ১৩ রান।

সৌম্য সরকারের পক্ষে যুক্তির জায়গা হলো তিনি বেশ ভালো পেস বোলিং খেলতে পারেন। তবে মাঝে মাঝে তাও বেশ মিস করে ফেলেন তিনি। এছাড়াও পেস বোলিংয়ের বিরদ্ধে সৌম্য সরকারের দূর্বলতার জায়গাটা হলো তিনি অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল ঠিক মত খেলতে পারেন না।

যদি সৌম্য সরকারকে নিউজিল্যান্ডে টপ অর্ডারে খেলানোর পরিকল্পনা আগে করা হয়, তবে সেটা বেশ বিস্ময়কর। কারণ তিনি সর্বশেষ দুই বছরে সীমিত ওভারে নতুন বল  মোকাবিলা করার সুযোগই পাননি। প্রথম ম্যাচে সৌম্য যখন মাঠে আসেন তখন কেবল মাত্র ম্যাচের মাত্র চতুর্থ ওভার চলে।

বাংলাদেশের অধিনায়ক তামিম ইকবাল ট্রেন্ট বোল্টের বলে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিলো। তাঁর দূর্দান্ত কিছু আউট সুইংগারে বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন তিনি। আর এক পাশে বেশ ভালো ভাবেই ম্যাট হেনরিকে মোকাবিলা করছিলেন। কিন্তু বোল্টের এক দূর্দান্ত ইনসুংগারে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান তামিম। তামিমের আউটের পর যখন সৌম্য মাঠে আসেন তিনি টিকে ছিলেন মাত্র তিন। এক বাউন্সার পেয়ে কাভারে ক্যাচ দিয়ে আউট হন সৌম্য।

সৌম্যের এই আউট মনে করিয়ে দেয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ডানেডিনে তৃতীয় ওয়ানডেতে কিভাবে টিম সাউদির ইন সুইংগার মিস করেছিলো। এই সময়ে সৌম্য সরকার পা দিয়ে বলকে আঘার করতে চেয়েছিলো কিন্তু বল গিয়ে অফ স্ট্যাম্পের উপরে গিয়ে লাগে। এই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম দুই উইকেট পড়ে যায় মাত্র ৩ রানে। এরপর বাংলাদেশের মিডল অর্ডার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও মাত্র ৮৮ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। আর এইবার এর থেকে একটু বেশি ১৩১ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ।

তামিম প্রথম ম্যাচের সৌম্যের অবস্থান ব্যাখা করতে গিয়ে জানান, ‘আমি জানি আমরা সৌম্যকে সাধারণত সাত নাম্বারে দেখি। কিন্তু আপনি যদি আমাদের কম্বিনেশন দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন আমাদের কোনো ছয় নাম্বার বোলার নেই।’

এছাড়া তিনি আরো বলেন, ‘বিয়াদ ভাই বোলিং করতে পারবে না কারণ তাঁর পিঠের ইনজুরি আছে। সৌম্য আমাদের ছয় নাম্বার বোলিং অপশন এবং আজকের দলের জন্য সে তিন নাম্বার পজিশনের জন্য বেশ ভালো ছিলো। এর আগেও সে নিউজিল্যান্ডে তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাটিং করেছে।’

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং গড় ছিলো মাত্র ৭.৩২। বাংলাদেশের টপ অর্ডার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সব সময় সংগ্রাম করে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের গড় মাত্র ১৩ থেকে ৩২.২২ এর মধ্যে। টপ অর্ডারদের মধ্যে তামিম ইকবালের ১৪ ইনিংসে চারটি হাফ সেঞ্চুরি আছে। আর টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের মধ্যে একমাত্র ইমরুল কায়েস সেঞ্চুরি করেছেন। এখানে মাত্র চারটা ৫০ রানের বেশি জুটি আছে বাংলাদেশের টপ অর্ডারে।

নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের আরো বেশ ভালোভাবে ব্যাটিং করা উচিত করা উচিত ছিলো। শুরুতেই যদি উইকেটে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা সেট হয়ে যেতে পারতো তাহলেই এই উইকেটে নতুন বলে বোলারদের জন্য কোনো সুবিধায় ছিলো না। এখানে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয় দিনের প্রথম ঘন্টা।

সর্বশেষ দুই দশকে নিউজিল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলিং আক্রমণ গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের মাটিতে কিছুটা খেলার সুযোগ পায়। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেই সুযোগটা নেই বললেই চলে। তাই এখানে ভালো করা টা খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটি বিষয়।

অনেক সময়ই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আফতাব আহমেদ, মোহাম্মদ আশরাফুল, সাব্বির রহমান এবং সৌম্য সরকারের মত হার্ড হিটার ব্যাটসম্যানদেরকে তিন নাম্বার পজিশনে নামিয়ে চেষ্টা করানো হয়েছিলো। কিন্তু কেউ কখনো সফল হতে পারেননি।

গত বছরের শুরুর দিকে সৌম্য সরকারকে হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিলো। কারন তিনি ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষে বেশ ভালো করছিলেন। নিউজিল্যান্ডে তাঁর সেরা ইনিংস ছিলো ২০১৯ সালে হ্যামিল্টন টেস্টে ১৪৯ রানের টেস্ট ইনিংস। এর পর থেকেই তিন ফরম্যাটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা গিয়েছিলো তাকে। এর ফলে তিনি দলে নিজের ভূমিকা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন।

জানুয়ারীতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের আগে শান্তকে জাতীয় দলে সাকিবের পরিবর্তে তিন নাম্বার পজিশনে খেলতে নামিয়েছিলো। কারণ তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ দূর্দান্ত পারফর্ম করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলে নিজের সেই ফর্ম ধরে রাখতে পারেননি তিনি।

নাজমুল হাসান শান্ত সর্বশেষ এক বছরে পাঁচ ওয়ানডেতে তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাট করে ৭৩ রান করেছেন। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিপক্ষে ওয়ানডে এবং টেস্ট সিরিজে করেছিলেন ৩৮ এবং ৪০ রান। এর ফলে তাকে এই সিরিজের প্রথম ম্যাচের একাদশে রাখা হয় নাই। সর্বশেষ ১০ বছরে তিন নাম্বার পজিশন নিয়ে বেশ চিন্তিত আছে বাংলাদেশ দল। এই জায়গায় কোনো ব্যাটসম্যানই ২৩ ইনিংসের বেশি ব্যাট করতে পারেননি। ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব তিন নাম্বার পজিশনে দূর্দান্ত ব্যাটিং করার পরও তাকে আর তিন নাম্বার পজিশনে নামানো হয় নাই, এটা থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশ দল কতটা অধৈর্য এই জায়গাটা নিয়ে।

নির্দিষ্ট ভাবে বললে ২০১৯ বিশ্বকাপে ৮৬.৫৭ গড়ে ৬০৬ রান করে বাংলাদেশকে তিনটি জয় এনে দিতে মূখ্য ভূমিকা রাখে। এটা শুধু বাংলাদেশের টপ অর্ডারকে স্থায়ী করেনি। সাকিব তামিম কিংবা সৌম্যকে সাথে নিয়ে বেশ দূর্দান্ত কিছু পার্টনারশীপ গড়ে তুলেছিলো। সবশেষ দশ বছরে দেখা গেছে দেশের বাইরে বাংলাদেশ দলে টপ অর্ডার সফল হইলেই বাংলাদেশ দল জিতেছে। এই থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশ দলের জয়ে টপ অর্ডারের ভূমিকা কতটা।

বাংলাদেশ দলকে এই সিরিজে ভালো করতে হলে তিন নাম্বার পজিশনে নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। শান্ত উপর আবারো দল আস্থা রাখতে পারে। যদি সে সেই রকম কোনো পারফর্ম করতে পারেন।

________________

ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে মোহাম্মদ ইশামের The No. 3 problem – Bangladesh’s never-ending search for an answer শিরোনামে প্রকাশিত লেখা অবলম্বনে।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link