বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা লম্বা সময় পাড়ি দিয়েছে পাঁচ জন ক্রিকেটারের উপর ভরসা রেখে।
সদ্য ক্রিকেটবিশ্বে হামাগুড়ি দেয়া দলটা তাঁদের হাত ধরেই হাঁটতে শিখলো। তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। সেই আঠারো বছর, যারা পদাঘাতে ভাঙতে চাইতো পাথর বাঁধা তাঁরা খানিকটা হাপিয়ে উঠেছেন। তবে তাঁর আগে সেই হামাগুড়ি দেয়া দলটাকে মাথা উচু করে, সোজা হয়ে দাড়াতে শিখিয়ে ফেলেছেন। শুধু হাঁটতেই শিখাননি, দলটা এখন গোটা ক্রিকেটবিশ্ব দাপিয়ে বেড়ায়। তবে সময় যে বড়ই পাথর। প্রায় পনেরো বছর পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচে খেলেননি সেই পাঁচ জনের কেউই।
তবে তাঁদের এই না খেলাটা আমাদের একটা বার্তা দিয়ে যায়। মনে হয় লিটন, আফিফ, নাঈম শেখদের খেলা দেখে সেদিন তাঁরা বলছিলেন, ‘যখন আমি থাকব না, কী করবিরে বোকা!’
আসলেই কী করবে তখন বাংলাদেশ। আমাদের বোধহয় এখনই সময় সিনিয়রদের কাঁধে পুরো ভার তুলে না দিয়ে তরুণদেরও কিছু দায়িত্ব নেয়ার। সেটার শুরুটা অন্তত হতে পারে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। ক্রিকেটের ছোট্ট এই ফরম্যাটটায় প্রয়োজন কিছু তরুন রক্ত; একদল অদম্য সাহস। সেই দলে আমাদের তরুণ ক্রিকেটারদের পাশাপাশি যুক্ত হতে পারে বিশ্বকাপ জয়ী যুব দলটার কয়েকজনও। টানা কিছু সিরিজ একটা তরুণ দলের ওপর ভরসা রাখলে তাঁরা হয়তো দেশের ক্রিকেটকে নিয়ে যেতে পারেন এক নতুন উচ্চতায়। অন্তত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে, যেখানে আমাদের হারানোর কিছু নেই।
আগামী কয়েক বছরের পরিকল্পনা করে খেলা ৭১ তৈরি করেছে একটি টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড, দলে রাখা হয়েছে ১৬ জনকে। যে দলটি সাজানো হয়েছে তারুণ্যের মিশেলে। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আছেন কিছু অভিজ্ঞ কান্ডারিও। আমাদের বিশ্বাস এই দলটায় বিনিয়োগ করলে আমরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সাফল্য তো বটেই তাছাড়াও পেয়ে যেতে পারি আমাদের ক্রিকেটের নতুন কিছু তারকাও।
দলে একজন অধিনায়ক, ও একজন সহ-অধিনায়কও রাখা হয়েছে, যাতে করে অধিনায়ক চলে গেলে নতুন অধিনায়ক খুঁজে পেতে সমস্যা না হয়।
- নাঈম শেখ
এই মুহুর্তে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যান আমাদের দলের ওপেনার নাঈম শেখ। মাত্র ৯ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেই এই ফরম্যাটে তাঁর কার্যকারিতার প্রমাণ দিয়েছেন।
৩৩.৬৬ গড়ে ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন ৩০৩ রান। এর মধ্যে ভারতের বিপক্ষে নাগপুরে প্রায় ১৭০ স্ট্রাইকরেটে খেলেছিলেন ৮১ রানের ইনিংস। পাওয়ার প্লে ব্যবহার করে দ্রুত রান তুলতে পারায় ম্যাচের শুরুতেই বিপক্ষ দলেই উপর চাপ প্রয়োগ করা যায়। তবে পাওয়ার প্লের পরে তাঁর স্ট্রাইকরেট ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এই দিকটায় কাজ করে স্ট্রাইক রোটেট করে খেলতে পারলে লম্বা সময় বাংলাদেশকে সার্ভিস দিতে পারবেন এই ওপেনার।
- লিটন দাস
অত্যন্ত প্রতিভাবান এই ক্রিকেটার তাঁর প্রতিভার সুবিচার কখনোই করতে পারেননি। তবে ডানহাতি এই ওপেনার উপমহাদেশের স্পিনিং কন্ডিশনে অসাধারণ একজন ব্যাটসম্যান। এমনকি বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর স্ট্রাইকরেটই সর্বোচ্চ ১৩৪.০২। এছাড়া এই মুহুর্তে দেশের অন্যতম সেরা উইকেট কিপারও তিনি। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে কিপিং গ্লাভসও তাই তাঁর হতেই থাকার কথা।
- সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক)
তিন নম্বর পজিশনে থাকবেন দলের অধিনায়ক ও সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান সাকিব আল হাসান। এই ফরম্যাটে ১২৩.৭৭ স্ট্রাইকরেটে সাকিবের ঝুলিতে আছে ১৫৬৭ রান। যা বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। যথারীতি স্পিন বোলিং অ্যাটাকেরও দায়িত্বে থাকবেন এই অলরাউন্ডার। খেলা ৭১ মনে করে – এই দলের অধিনায়ক হওয়ার উচিৎ সাকিবের।
- আফিফ হোসেন ধ্রুব
আফিফের অ্যাটাকিং ব্যাটিং স্টাইল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খুবই কার্যকর হতে পারে বাংলাদেশের জন্য। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৬.৬৬ স্ট্রাইকরেটে ৪৫ রানের একটি ইনিংস খেলেছেন তিনি। তাই চার নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নামবেন এই অলরাউন্ডার। তাঁর অফ স্পিনও মাঝেমাঝে দল সিক্সথ বোলার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
- মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত (সহ-অধিনায়ক)
মোসাদ্দেক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দলের একজন ইমপ্যাক্ট ফুল ক্রিকেটার হতে পারেন। তাঁর অ্যাটাকিং ব্যাটিং ও তাঁর স্পিন দুটো দিয়েই তিনি দলে ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে পাঁচ নম্বরে নিয়মিত ব্যাট করার জন্য তাঁকে ব্যাটিং নিয়ে আরো কিছু কাজ করতে হবে। ছোটখাটো সেই সমস্যা গুলো কাঁটিয়ে উঠলেই তিনি দলের গুরুত্ত্বপূর্ণ ক্রিকেটার হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবেও ভাবতে পারে বাংলাদেশ। তাঁকে এই দলে সহ-অধিনায়ক হিসেবে রাখছে খেলা ৭১।
- শামীম হোসেন পাটোয়ারি
এক কথায় বললে বাংলাদেশে শামীম পাটোয়ারির মত ব্যাটসম্যান রোজ আসেনা। মাসেল পাওয়ার আছে এবং এই পাওয়ার কী করে ইউজ করতে হয় জানেন। ফলে মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে বড় বড় শট খেলতে পারেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইমার্জিং দলের হয়েও তিনি দ্রুত রান তুলে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন।
শামীমের আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, তিনি এই মুহুর্তে দেশের অন্যতম সেরা ফিল্ডার। গ্রাউন্ডস ফিল্ডিংয়ে তার চেয়ে ভালো ফিল্ডার আমরা এর আগে পেয়েছি কি না, সে নিয়েই তর্ক চলতে পারে। এমন একজন ক্রিকেটারকেই দল ৬/৭ এ খেলানোর জন্য অনেক বছর ধরে খুঁজছিল। তাই ছয় নম্বর পজিশনে তাঁকে নিয়মিত সুযোগ দেয়া উচিৎ।
- মেহেদী হাসান
সাত নম্বরে ব্যাট করার জন্য একজন যোগ্য নাম হতে পারেন মেহেদী হাসান। দ্রুত ব্যাট চালিয়ে শেষদিকে দলের জন্য কিছু রান এনে দিতে পারেন তিনি। তাছাড়া তাঁর স্পিন বোলিংও তাঁকে একাদশে থাকতে সাহায্য করবে। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডেও তাঁর বোলিং পারফরম্যান্স ছিল কখনো কখনৈা প্রশংসনীয়।
- নাসুম আহমেদ
সাকিব ও মাহেদীর সাথে স্পিন বোলিং অ্যাটাকের দায়িত্বে থাকবেন বাঁহাতি এই স্পিনার। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ওই কন্ডিশনেও বেশ ভালো বোলিং করেছেন এই স্পিনার। তাছাড়া তাঁর ইকোনমি রেটও বেশ প্রশংসনীয়। অন্তত, এটা নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে।
- তাসকিন আহমেদ
ইনজুরির কারণে অনেকটা সময় দলের বাইরে থাকলেও বেশ শক্তিশালী ভাবেই ফিরে এসেছেন এই পেসার। এই মুহুর্তে দেশে নিয়মিত ১৪০ স্পিডে বল করতে পারেন এমন পেসার বোধহয় শুধু তাসকিনই আছেন। তবে লাইন লেন্থ নিয়েও আরো কাজ করা জরুরি এই পেসারের। জোরে বল করতে গিয়ে প্রায়ই লাইন লেন্থ হারিয়ে ফেলেন তিনি।
- শরিফুল ইসলাম
শরিফুলের গড়নই ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠার খুব উপযুক্ত। মাঠেও তাঁর দৈহিক ভাষা তাঁকে এগিয়ে রাখে। যেকোনো কন্ডিশনে ডমিনেট করে বল করতে পারেন এই পেসার। বিশেষ করে তাঁর বাউন্সার বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরানোর জন্য যথেষ্ট। অনুর্ধব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এই পেসার।
- মুস্তাফিজুর রহমান
পেস বোলিং অ্যাটাকের কান্ডারি থাকবেন বাঁহাতি এই পেসার। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর বোলিং যেকোনো কন্ডিশনে ,যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই ভয়ানক হতে পারে। তাঁর চার ওভার বাংলাদেশ দলের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হতে পারে।
- সৌম্য সরকার
তরুণ বললেও, এই দলের বিবেচনায় খুবই অভিজ্ঞ সৌম্য সরকার। ৫০-এর ওপর টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলেছেন। প্রায়েই যদিও, তাঁর ফর্ম নিয়ে শঙ্কা ওঠে – তবুও ছন্দে থাকলে তিনি বেশ দ্রুত গতিতে রান তুলতে পারেন। আর মিডিয়াম পেস বোলিংটা দলের জন্য বাড়তি একটা প্রাপ্তি।
- পারভেজ ঈমন
ওপেনিং এর ব্যাকআপ হিসেবে স্কোয়াডে থাকতে পারেন পারভেজ ঈমন। নাঈম শেখ বা লিটনদের কেউ ক্লিক না করলে একাদশে জায়গা পেতে পারেন তিনি। যেহেতু উইকেট কিপিং ও করতে পারেন তাই লিটনকেও রিপ্লেস করতে পারবেন এই ওপেনার। গত বছর ফরচুন বরিশালের হয়ে ৪২ বলে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েছিলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। মাত্র আঠারো বছর বয়সী এই কিশোরকে দেখেশুনে রাখলে বাংলাদেশের বড় সম্পদ হতে পারেন তিনি।
- মাহমুদুল হাসান জয়
জয় অনুর্ধব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলটার সবেচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইমার্জিং দলের হয়েও মিডল অর্ডারে অসাধারণ ব্যাট করেছেন তিনি। জয়ের হাতে শট কিছুটা কম থাকলেও জয় টেকনিক্যালি খুব শক্তিশালী। তাই শট নিয়ে কিছু কাজ করলে তিনি জাতীয় দলেও মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে পারেন। আফিফ, মোসাদ্দেকরা ক্লিক করতে না পারলে তাঁদের জায়গায় আসতে পারেন জয়।
- মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাইফুদ্দীনের মত কার্যকর পেস বোলিং অলরাউন্ডার খুব কমই এসেছে। নিজের ব্যাটংটা নিয়ে আরো কাজ করতে পারলে তিনি সাত নম্বরে ব্যাট করতে পারেন। তাছাড়া বল হাতে ডেথ ওভারে দেশের অন্যতম সেরা বোলার তিনি। তাই ৭-৮ এ মাহেদী বা নাসুমের জায়গায় তিনিও একাদশে আসার দাবিদার।
- হাসান মাহমুদ
বাংলাদেশের পেস বোলিং অ্যাটাকের নতুন অস্ত্র হাসান মাহমুদ। গত বছর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন এই পেসার। ২০১৯-২০ বিপিএলে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন এই পেসার। ফলে বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটের নতুন সম্ভাবনাময়ী নাম হাসান মাহমুদ। তাসকিন, শরিফুলদের টপকে তিনিও যেকোনো সময় চলে আসতে পারেন একাদশে।