ঘুম ভুলেছি নিঝুম এ নিশীথে…
কণ্ঠে বাবা শচীন দেব বর্মন আর সরোদে পুত্র রাহুল দেব বর্মন। পিতা পুত্রের কী অসাধারণ এক যুগলবন্দী। বাপ বেটার সেই পুরনো যুগলবন্দীতে এখনো ডুবে থাকি আমরা। মুগ্ধতার রেশে অনেক সময় মাথা নত হয়ে আসে। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে চোখ বুজে আসে।
সঙ্গীতের মূর্ছনার সাথে বাইশ গজের ক্রিকেটের মিল টা ঠিক আসে না, অমিলটাই বেশি। তবে অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলে আবার, দুটোই শিল্প। ব্যাটিং-এর নান্দনিক সব শট, বোলিংয়ে সুইং, স্পিনের কারিশমা- এগুলোকে শিল্প না বলে উপায় কই! তারপরও শচীন দেব বর্মণ-রাহুল দেব বর্মণের উদাহরণ টানার কারণ হলো, একটি যোগসূত্র স্থাপন করা। বাইশ গজের ক্রিকেটেও পিতা-পুত্রের যুগলবন্দী আবিষ্কার করা।
সেই শত বছর আগে ডব্লিউ জি গ্রেস তাঁর পুত্রের সাথে একই সাথে বেশ কিছু ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালে একবার জিম্বাবুইয়ান পেসার হিথ স্ট্রিক আর তাঁর বাবা ড্যানিশ স্ট্রিক এক সঙ্গে খেলেছিলেন প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। আমাদের দেশের রকিবুল হাসানও তাঁর পুত্রকে নিয়ে একসাথে ওপেনিং করেছিলেন। ঢাকা লিগের ম্যাচে, সূর্য তরুণের হয়ে। আবার বাবা লালা অমরনাথের বিপক্ষে একবার একটি ম্যাচ খেলেছিলেন পুত্র মহিন্দর অমরনাথ।
আর এই শতাব্দীতে তো, বাবা শিবনারায়ণ চন্দরপলের সাথে একবার এক ম্যাচে আড়াইশো রানের জুটি গড়েছিলেন পুত্র তেজনারায়ণ চন্দরপল। বাবা-ছেলের এমন বিরল দৃশ্য বাইশ গজের ক্রিকেটে দেখা গেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিন্তু কখনোই দেখা যায়নি। তবে অনেকেই বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। কখনও কখনও বাবাকেও অর্জনে ছাপিয়ে গিয়েছেন।
আজকের গল্পটা বাবাকে পুত্রের ছাপিয়ে যাওয়ার নয়। বরং বাবার অর্জনের পাশে বসে অনন্য এক কীর্তির গল্প। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে কষ্টার্জিত এক জয় পেয়েছিল নেদারল্যান্ডস। আর সে ম্যাচে ৩ উইকেট আর ১৪ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছেন বাস ডি লিড।
এই বাস ডি লিড কে জানেন? ইনি সাবেক ডাচ অলরাউন্ডার টিম ডি লিডের পুত্র। টিম ডি লিড নিজেও ২০০৩ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। তবে পিতা, পুত্র ভিন্ন দুই বিশ্বকাপ খেলার মাঝে তেমন অনন্যতা নেই। এমন কীর্তি আরও অনেক আছে।
কিন্তু, ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে বোলিংয়ে দুর্দান্ত এক স্পেল করেছিলেন টিম ডি লিড। সে ম্যাচে তিনি ৩৫ রানে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। আর সেই ৪ টি উইকেটের মাঝে শচীন এবং রাহুল দ্রাবিড়ের উইকেটও ছিল। মূলত তাঁর বোলিং তোপেই ২০৪ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত।
নেদারল্যান্ডস সে ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি। মাত্র ১৩৬ রানেই অলআউট হয়ে গিয়েছিল তারা। তবে দুর্দান্ত বোলিংয়ের কারণে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের টিম ডি লিড।
২০২২-এ এসে সেই ১৮ বছর পর বাবার স্মৃতিই ফিরিয়ে আনলেন বাস ডি লিড। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচে হলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ভিন্ন দুটি বিশ্বকাপ, একটিতে বাবা ম্যান অব দ্য ম্যাচ, অন্যটিতে পুত্র ম্যান অব দ্য ম্যাচ! নিশ্চিতভাবেই বিরল এক ঘটনা। আরেকটু বাড়িয়ে, কাকতালীয় বললেও খারাপ হয় না।
তবে এমন কাকতালীয় ঘটনা এর আগেও হয়েছে। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মিচেল মার্শ। আর ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন মিচেল মার্শের বাবা জিওফ মার্শ। জিওফ মার্শ অবশ্য গ্রুপ পর্বেরই আরেক ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন। সেবার অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জিতেছিল। ৩৪ বছর পর ২০২১- এ বাবার মতোই অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের সঙ্গী হয়েছিলেন মিচেল মার্শ।
পিতার অর্জনের পাশে পুত্রের নাম। যুগলবন্দীতে না হোক। বাবার পদাঙ্কনেই তো এগিয়েছে পুত্র। সেটাই তো বাবার কাছে পরম তৃপ্তি আর পু্ত্রের বোধোদয়ে গর্বের এক বিষয়। ক্রিকেট বিশ্ব ঠিক এমন পিতা পুত্রের কৃতিত্বেই সমৃদ্ধ হতে থাকুক, এমন কাব্য গাঁথায় ক্রিকেট হয়ে উঠুক একটা মহাকাব্য।