ব্যাটিং শিল্প ও তার শিল্পী

শিল্পের সর্বগ্রাহ্য পরিভাষা দেওয়া সহজ নয়। অনেক বড় বড় মস্তিষ্ক এই চেষ্টায় বহু সময় এবং কালি ব্যয় করেছেন। যতদূর জানি গোটা দুই বইও আছে এই বিষয়ে। অর্থাৎ, বিষয়টা সহজ নয়।

কিন্তু, আমরা ব্যাপারটা একটু ন্যারো করে চিন্তা করার চেষ্টা করতে পারি? মানে, শিল্পের জেনারেল ডিফিনিশন দেওয়ার জায়গায় যদি বোঝার চেষ্টা করি ক্রিকেট মাঠে ‘শিল্প’ বলতে কী বোঝায়? আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে একজন ব্যাটসম্যানের কী কী গুণ বা চরিত্রগত বিশেষত্ব থাকলে তাকে ক্রীড়াপ্রেমীরা শিল্পীর দলে ঠাই দেন?

আসুন চেষ্টা করা যাক। প্রথম কয়েকটি বিশেষত্ব সহজেই অনুমেয়। যেমন ধরুন কব্জির মোচড়। বিশ্বনাথ, লারা বা আজাহারের কব্জির মোচড় বহু ক্রিকেট সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। এই শটগুলি যে দর্শনীয় হয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু কিছুটা কার্যকারীতাও আছে বইকি। একই লেন্থ, লাইনের বল যখন কখনও কাভার, কখনও মিড উইকেট বাউন্ডারির দিকে ছুটে যায় তখন ক্যাপ্টেন এবং বোলারদের ফিল্ড সেটিঙের সমস্যা সহজেই অনুমেয়।

কিন্তু এই কব্জির কারসাজীর সঙ্গে ঝুঁকিও জড়িয়ে রয়েছে। সোজা ব্যাটে খেলার কথা সব কোচিং ম্যানুয়াল বলে সঙ্গত কারনেই। সোজা ব্যাটে খেললে ব্যাটের সবচেয়ে বিস্তীর্ণ অংশ বলের মুখোমুখি হয়, সময়জ্ঞানে একটু হেরফের হলেও ক্ষতি খুব একটা সাংঘাতিক হয় না। অন্যদিকে কব্জির জাদু দেখাতে গেলে প্রায়ই ব্যাট একটা এঙ্গেলে নেমে এসে বলের সঙ্গে মিলিত হয়। এবং ব্যাটে বলের সংঘর্ষের সময়টিতে ব্যাটসম্যান নিজের কব্জির সাহায্যে বলকে প্লেস করেন নিজের পছন্দের জায়গায়। সামান্যতম টাইমিঙ্গের হেরফের হলেই সেদিনের মতো ছবি আঁকা শেষ।

তবে এই ধরনের ব্যর্থতাকে শিল্পীরা খুব একটা গা করেন না। তাদের খেলার এবং জীবন-দর্শনের মধ্যে একটা উদাসীন, গা ছাড়া ভাব থাকে। এমন কি ব্যাট করার ভঙ্গিতেও কেমন যেন একটা অলসতা – লেজি এলিগ্যান্স। অনেক সময়ই দেখা যায় ফুটওয়ার্কের ব্যাপারে তারা খুব একটা চিন্তিত নন, ব্যাট আর পায়ের মধ্যে ফাঁক থেকে যায় প্রায়ই, অফ স্ট্যাম্পের ওপরের বলকে ক্রিজে দাঁড়িয়ে ফ্লিক করতে তাদের বাঁধে না।

অথবা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে স্রেফ বডি ওয়েট পেছনের পায়ে ট্রান্সফার করে মিড উইকেট আর মিড অনের মাঝখানে অবহেলায় পুল বা হুক খেলতে (তারপর হয়ত ফটোগ্রাফারদের খাতিরে একটা পা শুন্যে তুলে পোজ দিলেন)। ঠিকই ধরেছেন, মানসচক্ষে আমি এখন ভি ভি এস্-কেই দেখছি বটে।

কব্জির মোচড়, অলস জীবন দর্শন এবং ফুটওয়ার্কের অভাবের প্রায় হাত ধরে শিল্পী ব্যাটসম্যানদের খেলার মধ্যে একটা বস্তু খুব কমন – আন-প্রেডিক্টেবিলিটি। এর আবার কয়েকটা স্তর আছে। প্রথম, কোন বলে কোন শট মারবেন সেই ব্যাপারে আন-প্রেডিক্টেবিলিটি। দুই, ধারাবাহিকতায় আন-প্রেডিক্টেবিলিটি। যে দলের মূল ব্যাটিং স্তম্ভ শিল্পী হন, সেই দলের কপালে দু:খ আছে।

দু:খের কারণ তারা ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের খেলার ধরনের পরিবর্তনে বিশ্বাসী নন। এর ফলে বহু ড্র হওয়া ম্যাচ তাদের ব্যর্থতায় হারতে হয়। আবার কিছু অকল্পনীয় জয়ও তারা উপহার দেন। তিন, বোলিং আক্রমণের স্তর অথবা পিচের কারসাজি তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতায় আশানুরূপ প্রভাব ফেলে না। বরং কিছু কিছু ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিস্থিতি যত কঠিন, তত খোলতাই হয় তাদের খেলা।আবার সহজ ব্যাটিং উইকেটে, দুর্বল বোলিঙের বিরুদ্ধে অনেকটা যেন বোর হয়েই নিজের উইকেট উপহার দিয়ে আসেন তাঁরা।

ক্রিকেট ইতিহাসে এই ধরনের ইনিংসের উদাহরণ অজস্র। গরুরাও হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খাবে এই ধরনের উইকেটে ট্রাম্পারের ৭৪। লারওয়ুডের বডিলাইন বোলিংকে কাউন্টার অ্যাটাক করে ম্যাকক্যাবের ১৮৭ (ওনার আরও একটা মারকাটারি ইনিংস আছে। সে ক্ষেত্রে ওনার ব্যাটের প্রহার থেকে নিজের দলের ফিল্ডারদের বাঁচাতে ব্যাড লাইটের আবেদন করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপ্টেন)। ফলো অন করে ভিভিসের ২৮১। ম্যাকগ্রা – ওয়ার্নের বোলিঙকে ছিন্নভিন্ন করে লারার ১৫৩।

শিল্পীদের ব্যাটিংয়ের আরও একটা বিশেষত্ব হচ্ছে তাদের ব্যাটিংয়ের মূল স্তম্ভ তাদের শক্তি নয়, টাইমিং। পেশিবহুল, শক্ত-সমর্থ শরীরের ব্যাটসম্যানকে সাধারণত শিল্পীদের দলে ফেলা হয় না। আবার লম্বা, ছিপছিপে শরীর তাদের অন্যতম বিশেষত্ব (এখানে ব্যতিক্রম আছেন – ভিশি, লারা)। মানছি ব্যাপারটায় যুক্তি নেই কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে যুক্তির আশা করাটাও বাহুল্যতা।

তাই ভিভ, শচীন, বিরাট বা এবি শিল্পীদের দলে পড়বেন না যদিও তাদের ব্যাট থেকে সুন্দর শট বেরোয় না এই কথাটা তাদের অতিবড় শত্রুও বলবেন না। কিছু ক্ষেত্রে তাদের শারীরিক সৌন্দর্য তাদের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে তাদের প্রভাব আরও বাড়িয়ে তোলে ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে। ট্রাম্পার, ওরেল, মার্ক ওয়া এবং ডেভিড গাওারের মতো ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য।

ফ্যান্সি শট নিতে পছন্দ করেন শিল্পীরা। অর্থাৎ যে শটে ঝুঁকি বেশি। এবং সেই শট নেওয়ার জন্যে তারা উইকেটে সেট হওয়া অব্দি অপেক্ষা করেন না। ডেভিড গাওায়ারের জীবনের প্রথম টেস্টে, প্রথম খেলা বলটি অবলীলায় বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কী ধরনের ফ্যান্সি শট? ভিক্টর ট্রাম্পার নাকি মিড উইকেট থেকে ফাইন লেগ – একই বলকে লেগ গ্লান্সের মাধ্যমে এর মধ্যে যে কোন জায়গায় পাঠাতে পারতেন।

বিশ্বনাথের স্কয়ার কাট আটকাবার জন্যে দু দুটো থার্ড ম্যান রেখেও লাভ হয় নি – দুটোর মাঝখান দিয়ে সীমানার বাইরে বল পাঠাতেন ভিশি। রোহান কানহাই সুইপ খেলার সময় মাটিতে শুয়ে পড়তেন প্রায়ই (আজকাল রিশভ পন্থ পড়েন, তবে তিনি সুইপ ছাড়াও আরও অনেক শট খেলার সময় শুয়ে পড়েন)।

মাহেলার লেট কাট দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় অফ আর মিডল স্ট্যাম্পের মাঝখান দিয়ে বোধহয় বলটা গেল। এতটাই ফাইন। ভিভিএস লক্ষ্মণ ওয়ার্নের স্পিনের বিরুদ্ধে ক্রিজের বাইরে এসে প্রায়ই তাকে মিড উইকেট বাউন্ডারির বাইরে নিক্ষেপ করতেন। স্বয়ং ইয়ান চ্যাপেলের মতে উঁচু মানের স্পিনের বিরুদ্ধে এত ভালো ব্যাটিং তিনি দেখেন নি।

একটু আগে লিখেছি বোলার এবং ক্যাপ্টেনদের ব্যাতিব্যস্ত করে তোলেন শিল্পীরা তাদের খামখেয়ালি স্ট্রোক প্লের মাধ্যমে। ফিল্ডাররাও কিন্তু কম নাকাল হন না তাদের হাতে। একটা আলতো ব্যাটের স্পর্শে হয়ত কাভার আর মিড অফের মাঝখানে বলটি প্লেস করলেন ব্যাটসম্যান। এক, বড়জোর দুই রান। কিন্তু তারপরই দেখা যায় এক অদ্ভুত দৃশ্য। ফিল্ডারের ছোটার গতির সঙ্গে সঙ্গে বলটির ছোটার গতি যেন বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ঠিক দুই ফিটের লিড নিয়ে সীমানা পেরল বলটা। যেন একটা দুরন্ত, আমুদে শিশু খিলখিল করে হাসতে হাসতে বোকা বানাল তাকে ধরতে আসা অন্য একটা শিশুকে।

শিল্পীদের আরও একটা বিশেষত্ব হচ্ছে তাদের ব্যাটিং গড় সাধারণত ৪০ থেকে ৫০-এর মধ্যে হয়। এর উদাহরণ অজস্র – ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, ম্যাককেব, ফ্র্যাঙ্ক উলি, জাহির আব্বাস, রোহান কানহাই, মার্ক ওয়াহ, ডেভিড গাওয়ার, আজাহার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, মাহেলা জয়ববর্ধনে। তবে ব্যতিক্রম আছেন। যেমন ভিক্টর ট্রাম্পারের গড় ৩৯, লারার ৫৩।

লারা আরও কয়েকদিক দিয়ে ব্যাতিক্রমি। লারার ফুটওয়ার্ক দেখে তাকে অলস মনে হবে না কখনই। অন্য শিল্পীরা যেখানে প্রয়োজনের চেয়ে অনেকসময় কম ব্যাট ঘোরান, লারার মধ্যে ব্যাট ঘোরানোর আতিশয্য দেখা যেত। যেমন স্কয়ার কাট খেলার পর মাথার ওপর চক্রাকারে ব্যাট ঘোরানো। ফ্লিক বা গ্লান্স খেলার পর যেন বলকে ব্যাট দিয়ে ওয়েভ করা। এবং অত্যাধিক ব্যাক লিফট।

তবে শিল্পীদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে দর্শকদের হৃদয় জয় করার ক্ষমতা। তারা যখন তাদের ফর্মের তুঙ্গে থাকেন তখন তাদের ব্যাটিং দেখলে মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর, স্বাভাবিক দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না। তাদের যারা খেলতে দেখেছেন তারা সেক্ষেত্রে কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজি হন না যে তাদের চেয়ে বেশি রান সংগ্রহকারী, অপেক্ষাকৃত বেশি গড়ের ব্যাটসম্যানেরা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

তাদের চোখে ব্র্যাডম্যানের চেয়ে ট্রাম্পার ওপরে, হাটনের চেয়ে উলি, উইক্সের চেয়ে ওরেল, সোবার্সের চেয়ে কানহাই, সানির চেয়ে ভিশি, মিয়াঁদাদের চেয়ে জহির, শচীনের চেয়ে লক্ষ্মণ এগিয়ে থাকেন (একবার লক্ষণের সঙ্গে সচিনের এক লম্বা পার্টনারশিপ শেষ হলে শচীন বলেন, নন স্ট্রাইকার এন্ড থেকে ওর ব্যাটিং দেখার সময় বারবার নিজেকে বোঝাই, এসব তুমি চেষ্টা কোরো না। চিন্তা করুন, শচীন!)। এখানেও লারা ব্যতিক্রম। তার সময়ে মোট রান এবং গড়ে তিনি পিছিয়ে ছিলেন না প্রায় কারও চেয়েই। এবং বড় ইনিংস খেলার ক্ষমতার ব্যাপারে তো তিনি লিজেন্ড।

আধুনিক টি-টোয়েন্টির পৃথিবীতে অবশ্য শিল্পীদের পক্ষে বাঁচা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। এ খেলা শক্তির, পেশির। লেজি এলিগ্যান্সের চেয়ে পরিশ্রমের দাম অনেক বেশি। যে কোন মুল্যে জয় এখানে সাফল্যের ব্যারোমিটার। অনেকেই আজকাল ভ্রু কুঁচকে বলেন, সৌন্দর্য – সেটা কী বস্তু?

ভিক্টর ট্রাম্পার সবুজ গালিচা আর সুনীল আকাশের প্রেক্ষাপটে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হত এবার অর্কেস্ট্রা আরম্ভ হতে চলল। স্ট্যান ম্যাককেবের ইনিংস দেখে নেভিল কারডাসের মনে হয়েছিল ট্রাম্পারের তরবারি এবং পোশাক ধারণ করার যোগ্য উত্তরাধিকারী এসে গেছে। আমরাও দেখেছি ভিশির পর আজাহার, আজাহারের পর লক্ষণের কব্জির যাদু। কিন্তু সেই ব্যাটন তুলে নেওয়ার লোক আজ কোথায়?

শুধু কি ক্রিকেট? অন্য খেলাতেও শিল্পীর আকাল দেখা যাচ্ছে। মেসির পায়ের বা ফেডেরারের কব্জির জাদু আবার কখন ফুটবল মাঠে বা টেনিস কোর্টে দেখা যাবে এ ব্যাপারে খুব কম ক্রীড়া প্রেমিই বাজি ধরতে রাজি হবেন। আর দেখা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝতেও পারবে না মাঝারি রেকর্ডের অধিকারী এক ব্যাটসম্যানকে নিয়ে তাদের বাবা – কাকাদের কিসের এত ‘উহ-আহ’ শব্দ। জীবনে কয়টা ছয় মেরেছে তারা? কবার তাদের শট স্টেডিয়াম পেরিয়েছে?

জেনারেশন গ্যাপ! হয়ত তাই। বা হয়ত আরও ব্যাপক কিছুর গ্যাপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link