ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে কিছু মন্তব্য করার জন্যে উচ্চ পর্যায়ে কিছুটা ক্রিকেট খেলা দরকার। সেটা নেই বলে এতদিন এই বিষয়ে কখনও মন্তব্য করি নি। তবে হেডিংলির ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর সুনীল গাভাস্কার এবং সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের সঙ্গে হার্শা ভোগলের আলোচনা কিছুক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলাম। বিষয় – বিরাট কোহলির ব্যাটিং। সেই সঙ্গে ভারতেরও।
সানি এবং সঞ্জয় দুজনেরই কথাবার্তা সবসময় যে যুক্তি মেনে চলে তা নয়। তবুও অন্যান্য অনেক এক্সপার্টদের চেয়ে আমি তাদের শুনতে বেশি পছন্দ করি প্রধানত দুটি কারনে। এক, দুজনেই উঁচু পর্যায়ের ক্রিকেট খেলেছেন বেশ কয়েক বছর ধরে এবং তাদের ডিফেন্সিভ ব্যাটিং টেকনিক খুব ভালো হিসেবে গন্য হত। দুই, এবং এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এখনও এরা ক্ষমতাবান ক্রিকেটারদের প্রয়োজন মতো সমালোচনা করতে ভয় পান না। যদিও সেটায় বেশ কিছু ক্রিকেট প্রেমী দেখেছি বেশ ক্ষুব্ধ।
যাই হোক, আসল কথায় আসি। সঞ্জয় দেখলাম বারবার উল্লেখ করছেন বিরাটের আগে থেকেই ফ্রন্ট ফুটে চলে আসার প্রবণতার কথা। এর ফলে বোলারদের সুবিধে হয়ে যাচ্ছে এবং তারা তাকে একই ধরনের লেন্থ এবং লাইনের বল করে আক্রমণ করতে পারছেন। রুটের মতো বিরাটও যদি নিজের ব্যাকফুটকে আরও বেশী ব্যাবহার করতে আরম্ভ করেন তাহলে বল খেলার বেশি সময় পাবেন এবং বোলাদেরও বাধ্য করবেন নিজের লেন্থ – লাইন পরিবর্তন করতে।
প্রথমে মনে হোল সঞ্জয় খুব একটা ভুল বলেন নি কারন এই সিরিজে বিরাটের ব্যাট থেকে ফাস্ট বোলিঙের বিরুদ্ধে কাট বা পুল চোখে পড়ে নি। কিন্তু তারপরই খটকা লাগল। এতদিন তো জানতাম বোলাররাই চান না কোন ব্যাটসম্যান তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকে ফ্রন্ট বা ব্যাক ফুটে চলে আসুক। সে ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে লেন্থের তারতম্য ঘটিয়ে তারা ব্যাটসম্যানকে আনসেটল করে দিতে চান।
কেউ যদি আগে থেকেই সামনের পায়ে চলে আসে তাহলে শর্ট বল করে তারা তাকে পেছনের পায়ে ঠেলে দিতে চান। এক্ষেত্রে তার কোন প্রয়োজনই পড়ছে না কারন বিরাট ফ্রন্ট ফুটে এলেও বারবার বলের স্যুইং রিড করতে ব্যর্থ হয়ে বিট হচ্ছেন। আর এই টেস্টে ইংল্যান্ড শর্ট বল প্রায় ব্যাবহার করেই নি। সুতরাং মোটের ওপর ফ্রন্ট ফুটে খেললে তো বিরাটের সুবিধেই হওয়ার কথা।
গাভাস্কার একটু অন্য কথা বললেন। ওনার মতে বল যখন স্যুইং করছে তখন ব্যাটসম্যানের উচিৎ বলের জন্যে অপেক্ষা করা। বিরাট যে ভুলটা করছেন সেটা হোল উনি বলকে অনুসরণ করে তাতে খোঁচা দিয়ে ফেলছেন। সেটা না করে উনি যদি বলের জন্যে অপেক্ষা করতেন তাহলে উনি বলটাতে বিট হলেও সেটা তার ব্যাটের কানায় লাগত না। বা কানায় লাগার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যেত। এছাড়াও সানি বেশ কয়েকবার বিরাটের শক্ত হাতে খেলার কথা উল্লেখ করলেন। যদিও উনি বলেন নি, কিন্তু নরম হাতে খেললে অনেক সময় ব্যাটের কানায় লাগলেও বল স্লিপ বা কিপারের হাত অব্দি ক্যারি করে না।
এছাড়াও অ্যানালাইসিসে দেখা গেল এই সিরিজে বিরাট সবগুলো আউটই হয়েছেন পঞ্চম থেকে সপ্তম স্ট্যাম্পের বল খেলে। সানির মতে এগুলো অনায়াসেই ছেড়ে দেওয়া যেত যদি না বিরাট বলগুলিকে ফলো করতেন। এই প্রসঙ্গে সঞ্জয় যোগ করলেন আগে থেকেই ফ্রন্ট ফুটে কমিট না হয়ে পড়লে বিরাটের পক্ষে এগুলোকে ছেড়ে দেওয়াও সহজ হতো। বিরাটের আউটগুলোর রিপ্লেতে এটাও দেখা গেল যে তিনি বলগুলোকে শরীর থেকে বেশ কিছুটা সামনে খেলছেন। এটা খেলা উচিৎ চোখের ঠিক নিচে। সানির কথামতো বলটাকে আরও একটু দেরীতে খেললে সেটা সম্ভব হবে।
একসময় শুনতাম ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ শট খেলার সময় এতটাই বলের কাছাকাছি পৌঁছাতে হবে যাতে বলের গন্ধ শুঁকতে পাওয়া যায় (স্মেলিং দ্য বল)। তবে সেটা বোধহয় স্পিনারদের বিরুদ্ধে, ভারতের মত কম বাউন্সের উইকেটে সম্ভব।
আরও একটা কথা মনে এল। বিরাট ফরওয়ার্ড খেলার সময় সামান্য সাফল করে অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে চলে আসছেন। আর তারই ফলে যে বলগুলো আসলে অফ স্ট্যাম্পের বেশ কিছুটা বাইরে, সেগুলো মনে হচ্ছে উইকেটের অনেক বেশি কাছাকাছি। আর তার ফলেই এই বলগুলো খেলতে তিনি বাধ্য হচ্ছেন। এই সাফল কমিয়ে ফেললে কি লাভ হবে?
এখনও পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ মনে হয়েছে রোহিত শর্মাকে। বেশিরভাগ ইনিংসেই তিনি ভুল শট সিলেকসানের ফলে আউট হয়েছেন, তাতে বোলারের ক্রেডিট কম। আমাদের অন্যান্য টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের তুলনায় তিনি বিটও অনেক কম হয়েছেন। আমাদের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে রোহিত সম্ভবত সবচেয়ে দেরীতে বল খেলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে বিরাট কি তার টেকনিকে এই ছোটখাটো এডজাস্টমেন্টগুলো করতে পারবেন? কাজটা কঠিন তবে গ্রেট ব্যাটসম্যানেরা যদি এই ধরনের ছোটখাটো ভুল – ত্রুটি দূর করতে না পারেন তাহলে তারা কিসের গ্রেট?
ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার জর্জ হ্যাডলি (ওনাকে ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’ নামে ডাকা হতো) ক্যারিয়রের আরম্ভের দিকে মূলত তার অফ সাইডের স্ট্রোক খেলার জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। বিখ্যাত লেগ স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেটের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা ব্যাপারটা বুঝে পরপর দুটো টেস্টে ওনার রান আটকে দেন ক্রমাগত লেগ স্ট্যাম্পের লাইনে বল ফেলে।
দ্বিতীয় আর তৃতীয় টেস্টের মাঝের সময়টায় হ্যাডলি নিজের টেকনিকে ঘষামাজা করে নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্যে। এরপর পরপর সাফল্য পান জর্জ। সিরিজ শেষে খোদ ক্ল্যারি গ্রিমেট মেনে নিতে বাধ্য হন যে তিনি জর্জ হেডলির চেয়ে উঁচু মানের অন সাইড প্লেয়ারের বিরুদ্ধে বল করেন নি।
তবে সবচেয়ে প্রথমে স্বীকার করতে হবে যে কিছু একটা সমস্যা রয়েছে। এবং তারপর শরণাপন্ন হতে হবে সেই মানুষটির যে তাকে সঠিক পরামর্শ দিতে সক্ষম। একসময় শচীন টেন্ডুলকার শেন ওয়ার্নকে খেলার ব্যাপারে পরামর্শের জন্যে রবি শাস্ত্রীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এবং ক্যারিয়ারের দ্বিতীয়ার্ধে ভিভের। অনেকে দেখছি সচিনের কভার ড্রাইভ বিহীন ২৪১ থেকে বিরাটকে শিক্ষা নিতে বলছেন।
আমার তো মনে হয় অতটা এক্সট্রিম স্টেপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই (আসলে আমি বিরাটের কভার ড্রাইভের একান্ত অনুরাগী)। বরং বিরাটের উচিৎ সচিনের প্রয়োজন মতো সঠিক মানুষের কাছে শিখতে চাওয়ার গুনটি করায়ত্ব করা। সানি, শচীন, রাহুল – এই তিনজন তো আছেনই, সঙ্গে দিলীপ বা সৌরভও রয়েছেন (শেষোক্ত দুইজন ইংল্যান্ডে সাফল্যের জন্যে)। এবং রয়েছেন বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন। রুটের বেশ কিছু লম্বা ইনিংস খুব কাছ থেকে দেখেছেন বিরাট। এই ধরনের পরিবেশে কিভাবে খেলা উচিৎ তার প্রদর্শনী দিয়ে চলেছেন রুট সারা সিরিজ জুড়ে।
তবে এই সিরিজের সবচেয়ে দর্শনীয় বস্তুটি নি:সন্দেহে জেমস এণ্ডারসনের বোলিং। সেই কিশোর অবস্থায় দেখেছিলাম কীভাবে অস্তগামী হ্যাডলি আমাদের ব্যাটসম্যানদের নাকানি-চোবানি খাওয়াচ্ছেন। এই সিরিজে এণ্ডারসনের বোলিং সেই স্মৃতি আবার পুনরুজ্জীবিত করছে। গতকাল বিরাটের উইকেটটিও আসলে তারই পাওয়ার কথা। ছন্দবদ্ধ রান আপ, মসৃণ বোলিং অ্যাকশন, নিখুঁত সিম পজিশন এবং অসামান্য স্যুইং – এই বস্তু ক্রিকেট মাঠে রোজ রোজ দেখা যায়না।