স্প্যানিশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় নামগুলো নিয়ে আলোচনায় বসলে বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের নাম আসতে বাধ্য। সত্য বলতে আলোচনার সবচেয়ে বড় হট টপিকই হবে এই দুই ক্লাব। হালের অ্যাটলেতিকো মাদ্রিদ, সেভিয়া ইউরোপে বেশ প্রভাব বিস্তার করলেও এই দুই ক্লাবের উচ্চতায় আসতে ঢ়ের পথ বাকি।
বার্সেলোনা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদ– দুই ক্লাবই স্পেনের জাতীয় গন্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক ক্লাব ফুটবলে নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষনা দিয়ে আসছে সগর্বে। ক্লাব ফুটবলের জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় উভয় ক্লাবকেই প্রতিপক্ষ দলগুলো সবসময়ই আলাদাভাবে সমীহ করে থাকে;বিশ্বজুড়ে উভয় ক্লাবেরই রয়েছে কোটি কোটি ভক্ত সমর্থক।
বিশ্ববিখ্যাত দুই ক্লাব যখন পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখন তা ফুটবলবোদ্ধা থেকে শুরু সমর্থকদের নজর কাড়বে তাই স্বাভাবিক বটে। দুই ক্লাবের মুখোমুখি লড়াইকে অভিহিত করা হয় ‘এল ক্লাসিকো’ নামে, যেটি ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্রুপদী লড়াইগুলোর একটি। শুধু তিন পয়েন্ট কিংবা একে অপরকে নক-আউট করার লক্ষ্যে ক্লাব দুটির খেলোয়াড়েরা ফুটবলীয় লড়াইয়ে নেমে যায় না। ক্লাব দুটোর লড়াই শুধু ফুটবলের না, দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি, দুটি ভিন্ন প্রদেশের আলাদা রাজনৈতিক মতাদর্শেরও লড়াই।
চলতি মৌসুমের তৃতীয় এল ক্লাসিকো মঞ্চায়িত করতে প্রস্তুত মঞ্চ। মঞ্চের নাম সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। এর আগে এই মৌসুমেই দুইবার মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল;একবার লা লিগাতে এবং অন্যটি ছিল স্প্যানিশ সুপার কাপে। দুইবারই শেষ হাসি হেসেছিল লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। এবার রিয়ালের ঘরের মাঠে মর্যাদার লড়াইয়ে নামতে চলেছে বার্সেলোনা।
হেড টু হেডে বার্সেলোনার চেয়ে এগিয়ে মাদ্রিদের ক্লাবটি। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে সর্বমোট ২৪৮ বারের দেখায় রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছিলো ১০০ বার এবং কাতালান ক্লাবটির জয় ৯৬ বার। ড্র-তেই নিষ্পত্তি হয়েছিল ৫২টি ম্যাচ। তবে সাম্প্রতিক লড়াইয়ের হিসেব করলেও পুরোপুরি বিপরীত অবস্থা এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর।
সর্বশেষ আটবারের দেখায় মাত্র দুইবার বার্সেলোনা জিতলেও পাঁচবারই জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ, এক ম্যাচ হয়েছে ড্র। মজার ব্যাপার,সর্বশেষ ছয়বারের দেখাতেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাতে পারেনি কাতালান ক্লাবটি, একবার ড্র করতে পারলেও বাকি পাঁচবারই হেরেছে তারা।
সাম্প্রতিক ফর্মের বিবেচনায় দুইদলই রয়েছে দারুন ছন্দে। লিওনেল মেসির বিদায়ের পর ভেঙ্গে পড়া বার্সা আবারো স্বরূপে ফিরছে জাভির কোচিংয়ে। সর্বশেষ এগারো ম্যাচ অপরাজিত জাভির শিষ্যরা। অন্যদিকে মৌসুমের শুরু থেকেই দাপট দেখানো রিয়াল মাদ্রিদও সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচ ধরে অপরাজেয়।
পিএসজির বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখার পর আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর আনচেলত্তির ছাত্ররা এবার ঘরের মাঠে বার্সার বিরুদ্ধে মাঠে নামবেন। লিগ টেবিলে একদিকে যেমন এক নম্বরে আছে রিয়াল মাদ্রিদ তেমনি তিন নম্বরে আছে এফসি বার্সেলোনাও৷ দুইদলের শক্তিমত্তা দেখে মনে হতেই পারে যেন বাঘ-সিংহের যুদ্ধ হতে যাচ্ছে বার্নাব্যুতে।
তবে ফুটবল নব্বই মিনিটের খেলা, খেলতে হয় মাঠের সবুজ ঘাসে। পুরোনো তথ্য কিংবা অতিত রেকর্ড দিয়ে ম্যাচের ফলাফল আনা যায় না। নব্বই মিনিট ধরে ভাল খেলা কিংবা গোল বেশি দেয়া দলটাই শেষ পর্যন্ত জিতবে। ম্যাচের আগমুহূর্তে তাই দুই দলই সতর্কতার সাথে সাজিয়ে নিচ্ছে রণকৌশল।
- স্কোয়াড
পিয়েরে অবমায়েং, আদামা ট্রাওরে, উসমান ডেম্বেলে, ফেরান তোরেস এর মত খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে তৈরি বার্সার আক্রমন রয়েছে দারুন ফর্মে। নতুন অবমায়েং – তোরেস কিংবা পুরোনো ডেম্বেলে, লুক ডি ইয়ং সবাই রয়েছে দারুন ছন্দে আর তাই বার্সার আক্রমনভাগ এখন নি:সন্দেহে সমীহ জাগানিয়া।
অভিজ্ঞ বুসকেটসের সাথে তরুণ গাভি, পেদ্রি’রা রয়েছে বার্সেলোনার মধ্যমাঠে। ডাচ মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, পেদ্রিদের ক্রিয়েটিভ প্লে-মেকিং বার্সেলোনাকে দিয়েছে নতুন রূপ। এছাড়াও ডিফেন্স সামলানোর দায়িত্বে আছে পিকে, আরাউহো, গার্সিয়া’রা।
অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় আস্থার নাম থিবো কোর্তায়া। পুরো মৌসুম জুড়ে দুর্ধর্ষ সব সেভ করে মুগ্ধ করা এই গোলরক্ষকের দিকে এই ম্যাচেও তাকিয়ে থাকবে রিয়াল। এছাড়াও মিলিটাও-আলাবা ডিফেন্সিভ জুটি ভাঙ্গাও প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিডফিল্ড রিয়ালের সবচেয়ে বড় গর্বের জায়গা। ক্যাসেমিরো,মদ্রিচ, ক্রুসদের সাথে রয়েছে তরুণ কামাভিঙ্গা এবং ফেদে ভালভার্দে। আক্রমণে রিয়াল মাদ্রিদের গত তিন মৌসুম ধরেই নায়ক বেনজেমা, আর এবারের মৌসুমে তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স চুরমার করে যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান সাম্বা বয় ভিনি জুনিয়র।
- সম্ভাব্য ট্যাকটিক্স
আগের ম্যাচগুলোর মতই ৪-৩-৩ ফরমেশনে দল সাজাতে পারেন জাভি। চারজনের ডিফেন্সে দুজন ফুলব্যাক; এর উপরে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে বুসকেটস, তার দুই পাশে দুই মিডফিল্ডার। সবার উপরে স্ট্রাইকার এবং দুই পাশে দুই উইঙ্গার।
এমন ফরমেশেনেই বার্সেলোনার মাঠে নামার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। মাঠে স্বভাবসুলভ পজেশনিং খেলা খেলার চেষ্টা করবে দলটি। পাশাপাশি দুই উইঙ্গারের গতি ব্যবহার করেও মাদ্রিদের ডিফেন্সের ভাল পরীক্ষা নিবে তারা। ডিফেন্সে অভিজ্ঞতা আর তারুন্যের মিশ্রন হতে পারে।
স্বাগতিক রিয়াল মাদ্রিদও তাদের প্রিয় ৪-৩-৩ ফরমেশনে মাঠে নামবে। ক্যাসেমিরো হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেও তার সঙ্গী বাকি দুজন কে হবে তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে। অভিজ্ঞ মদ্রিচ, ক্রুস কিংবা ইন ফর্ম ফেদেরিকো ভালভার্দেকে মিডফিল্ডে দেখা যেতে পারে।তবে বার্সেলোনার মত বল পায়ে রেখে ধীর গতির খেলা নয় বরং রিয়ালের লক্ষ্য থাকবে হাই প্রেসিং করে কাউন্টার এটাকে খেলা। ভিনি জুনিয়রের গতি এক্ষেত্রে রিয়ালকে অবশ্যই বাড়তি সুবিধা দিবে
- ইনজুরি
সার্জিও ডেস্টের ইনজুরি ছাড়াও বার্সেলোনার আর তেমন ইনজুরি সমস্যা না থাকলেও ইনজুরিতে রীতিমতো মাদ্রিদ ভক্তদের আশার বেলুন অনেকটাই চুপসে গিয়েছে। দলের অধিনায়ক এবং সর্ব্বোচ্চ গোলদাতা বেনজেমা কাফ ইনজুরিতে ছিটকে পড়েছেন৷
তাঁর অনুপস্থিতি রিয়ালের আক্রমন ভাগকে অনেকটাই নিস্তেজ করে দিয়েছে। পেশির ইনজুরিতে নিয়মিত লেফটব্যাক ফারলান্দ মেন্দির সার্ভিসও মিস করবে অল হোয়াইট’রা।
- শুরুর সম্ভাব্য একাদশ
বার্সেলোনা: টার স্টেগান, দানি আলভেস, আরাউহো, পিকে, জর্দি আলবা, বুসকেটস, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, পেদ্রি, ডেম্বেলে, গাভি, ফেরান তোরেস।
রিয়াল মাদ্রিদ: থিবো কোর্তোয়া, দানি কারভাহাল, মিলিটাও, আলাবা, নাচো ফার্নান্দেজ, ক্যাসেমিরো, মদ্রিচ, ক্রুস/ভালভার্দে, ভিনি জুনিয়র, রদ্রিগো, জোভিচ/বেল।
মর্যাদার লড়াই এল ক্লাসিকোতে একবিন্দু ছাড় দিবে না কেউ কাউকে। বার্সেলোনা নিতে চাইবে সর্বশেষ পরাজয়ের প্রতিশোধ আর রিয়ালের উদ্দ্যেশ্য আধিপত্য ধরে রাখা। জাভির নয়া টিকিটাকা নাকি আনচেলত্তির কাউন্টার অ্যাটাক; কার ট্যাকটিক্স বাজিমাত করবে ম্যাচে? দুই ফুটবল রাজার মহাযুদ্ধ দেখতে উদগ্রীব হয়ে আছে কোটি কোটি চোখ।