আম্পায়ারদের জীবনে সফলতা-ব্যর্থতা বের করার কোনো মাপকাঠি আসলে খুঁজে বের করা যায় না। একটা মানদণ্ড হতে পারে, একজন আম্পায়ার কত বছর টানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাজ করেছেন – সেই মাপকাঠিতে। আরেকটা হতে পারে – কয়বার তিনি আইসিসির বর্ষসেরা আম্পায়ারের খেতাব জিতেছেন।
এই দুই মাপকাঠিতেই পাকিস্তানের আলিম দার থাকবেন ওপরের দিকে। ১৭-১৮ বছর ধরে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এখানেই শেষ নয় – টানা তিনবার আইসিসির বর্ষসেরা আম্পায়ার হয়েছেন। ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ – তিনটি বছর তাঁর হাতে ওঠে এই পুরস্কার।
সেই কোন কালে পাকিস্তানের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে এলিট প্যানেলে নাম লিখিয়েছিলেন। বিশ্বকাপ করেছেন একটার পর একটা; বিশ্বকাপ ফাইনালও পরিচালনা করেছেন। টেস্ট ও ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ম্যাচ পরিচালনা করা আম্পায়ার তিনি।
তিনি ইতিহাসের একমাত্র আম্পায়ার যিনি কমপক্ষে ৫০০ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অন ফিল্ড কিংবা টিভি আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কত অর্জন, কত রেকর্ড – এই জীবনে তো কোনো অপূর্ণতা থাকার কথা নয় আলিম দারের। তবে, ছিল। আম্পায়ারিং জীবনের প্রথম ১৭ টার বছর তিনি নিজের দেশের মাটিতে কোনো ম্যাচ পাননি। তার সেই ১৩২ টেস্টের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি, করাচি টেস্টে দায়িত্ব পালন করা মধ্য দিয়ে।
প্রথম জীবনের আরেকটা অপূর্ণতা আজো তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেই অপূর্ণতা কখনোই ঘুঁচবে না।
আলিম দার ক্রিকেটারই হতে চেয়েছিলেন। আম্পায়ারিংয়ে আসার আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন। ছিলেন ব্যাটসম্যান ও লেগ স্পিনার। কিন্তু, তিনি বড় ক্রিকেটার হতে পারেননি।
পরে মনোযোগ দেন আম্পায়ারিংয়ে। ২০০০ সালে গুজরানওয়ালাতে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ম্যাচ দিয়ে আর্ন্তজাতিক অভিষেক হয়ে দারের। ২০০২ সালে আইসিসির ইন্টারন্যাশনাল প্যানেলে ঢোকেন। ২০০৪ সালে সুযোগ পান এলিট প্যানেলে।
২০০৭ সালে দশম আম্পায়ার হিসেবে শত ওয়ানডে পরিচালনার মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি; মাত্র ৭ বছরে এই ১০০ ম্যাচ পরিচালনা করে ফেলেন। পাঁচটা অ্যাশেজ ম্যাচ, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ পরিচালনা করেছেন।
২০০৩ সালে টেস্ট পরিচালনা শুরু করেন। ২০১৯ সালে ১২৯তম টেস্ট ম্যাচ পরিচালনা করেন। এর ভেতর দিয়ে স্টিভ বাকনারকে টপকে সর্বোচ্চ টেস্ট পরিচালনার রেকর্ড করে ফেলেন। ২০২০ সালে ২১০তম ওয়ানডে পরিচালনা করেন। এর ফলে রুডি কোয়ের্টজেনকে টপকে সর্বোচ্চ ওয়ানডে পরিচালনার রেকর্ডও নিজের করে নেন।
তবে, এই সাফল্য, এই অর্জনে কিই বা যায়-আসে যদি সেটা দেখার জন্য জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিই না থাকে। হ্যাঁ, আলিম দারের জীবনেও সেটাই ঘটেছে।
তখন ২০০৩ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকায় চলছিল বিশ্বকাপের আসর। তখন এপিলিপসিতে ভুগতে থাকা জাভেরিয়া নামে আলিম দারের ছোট্ট মেয়েটা মারা যায়।
স্ত্রী নওশাবা বানু খবরটা আলিম দারের কাছে পৌঁছাতে দেননি। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন কাজেই সবটুকু মনোযোগ থাকুক। তবে, খবর গোপন ছিল না। সেমিফাইনালে আগে পাকিস্তান দলের কয়েকজন সমর্থকের মারফত খবরটা এই আম্পায়ারের কানে যায়, পরের ফ্লাইটেই তিনি বাড়ি চলে আসেন।
কে জানে, খবরটা আগেই জেনে গেলে হয়তো আজকের আলিম দারকে পাওয়া যেত না। সেই আত্মত্যাগটাই আলিম দারকে বড় করে তুলেছে। তাই তো আজকে কত বড় বড় ঘটনা তাঁর চোখের সামনেই ঘটে যায়, আম্পায়ার হিসেবে তিনি নিজেও বিরাট সব কীর্তি গড়েন। এতো আলোর মাঝেও তিনি থাকেন নির্বীকার।