স্টিফেন ফ্লেমিং, আমার দেখা অন্যতম সেরা অনফিল্ড ক্যাপ্টেন। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের একজন, সত্যিকারের জেন্টলম্যান, ইন্সপিরেশনাল লিডার, মার্টিন ক্রোর যোগ্য উত্তরসূরি। ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ততটা সমৃদ্ধ না হলেও নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে একজন স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের অবদান অনস্বীকার্য, সেটা অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান দুই ভূমিকাতেই৷
আমরা যদি ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একটা তালিকা করতে বসি, তো সেখানে অবধারিতভাবে চলে আসবে ফ্লেমিংয়ের নাম। হয়ত সাফল্যের বিচারে সমসাময়িক অনেকের তুলনায় পিছিয়েই থাকবেন, তবে ফ্লেমিংয়ের মত একজন বিচক্ষণ, দূরদর্শী, থিংকিং অধিনায়ককে শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে মাপতে গেলে আপনি মস্ত বড় ভুল করবেন।
সীমিত রিসোর্স নিয়েও ফ্লেমিং যেটুকু সাফল্য অর্জন করেছেন, অনেক বড় দলের অধিনায়কও সেটা পারেন নি। তার কারণ একটাই, ফ্লেমিং জানতেন সীমিত রিসোর্স থেকে কিভাবে বেস্ট আউটপুট আদায় করতে হয়। ফ্লেমিংয়ের অধীনেই লেট নাইন্টিজ এবং আর্লি টু থাউজ্যান্ডে ক্রিকেট দুনিয়ার রাঘব বোয়ালদের সাথে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিতে আরম্ভ করে কিউইরা।
১৯৯৭ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে অধিনায়কের দায়িত্ব পান ফ্লেমিং৷ অভিজ্ঞতা নয়, তারুণ্যের উদ্দীপনা দিয়েও যে অধিনায়কত্বের চ্যালেঞ্জ জয় করা সম্ভব, ফ্লেমিং সেটা দেখিয়েছেন।
ফ্লেমিংয়ের টেস্ট অভিষেক ১৯৯৪ সালে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ভারতের বিপক্ষে। অভিষেকেই পাঁচ নম্বরে নেমে খেলেন ৯২ রানের ‘ম্যাচ সেভিং’ ইনিংস, যার সুবাদে অভিষেকেই জুটেছিল ম্যাচসেরার পুরস্কার। ক্যারিয়ারের শুরুতে ফ্লেমিং সতীর্থ হিসেবে পাশে পেয়েছেন মার্টিন ক্রো, কেইন রাদারফোর্ড, শেন থমসন, মার্ক গ্রেটব্যাচদের মত অভিজ্ঞদের। বলাই বাহুল্য, এদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন তিনি। অগ্রজদের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার কথাও জানিয়েছেন অসংখ্যবার৷
১৯৯৪-৯৭ এই তিন বছরে ২৩ টেস্ট খেলে ফ্লেমিং রান করেছেন ১৪৬৩, ব্যাটিং গড় ৩৮.৫০, সেঞ্চুরি মাত্র একটা। তেমন আহামরি কোন পারফরম্যান্স নয়। কিন্তু একজন তরুণ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান যে কিনা বিপর্যয়ের মুখে ইনিংস রিবিল্ড করতে জানে, তার জন্য এই পরিসংখ্যানকে বলতে হবে ইম্প্রেসিভ। নিউজিল্যান্ডের নির্বাচক প্যানেল তাই ফ্লেমিংয়ের হাতে অধিনায়কের দায়িত্ব সঁপে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবে নি।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের মাঝ পথে অফফর্মে থাকা অধিনায়ক লি জারমনের স্থলাভিষিক্ত হন স্টিভেন ফ্লেমিং৷ ক্রাইস্টচার্চে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ফ্লেমিং যখন টস করতে নামেন, তার বয়স ছিল ২৩ বছর ৩২১ দিন। নিউজিল্যান্ড ম্যাচ হারলেও বিচক্ষণতা ও সাহসী লিডারশিপ স্কিল দিয়ে সবার মন জিতে নেন ফ্লেমিং।
শুরুটা হার দিয়ে হলেও ক্রিকেট বিশ্বে নিজের সক্ষমতার কথা জানান দিতে খুব বেশি সময় নেন নি তিনি৷ একমাস পরেই অর্জুনা রানাতুঙ্গার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নাস্তানাবুদ করে ফ্লেমিং বাহিনী৷ পরের মাসে ফ্লাওয়ার ব্রাদার্স, হিথ স্ট্রিকদের ‘লড়াকু’ জিম্বাবুয়েকেও বরণ করতে হয় একই পরিণতি, হোয়াইটওয়াশ! ১৯৯৮ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে এসে ব্যর্থ হয় আজহারউদ্দীনের ভারতও। তিন টেস্টের হোম সিরিজটা ফ্লেমিংয়ের দল জিতে নেয় ১-০ ব্যবধানে।
সে বছর শ্রীলঙ্কার মাটিতে এওয়ে সিরিজ হারলেও পাল্টা আঘাত হেনেছিল ফ্লেমিংয়ের নিউজিল্যান্ড। কলম্বোর প্রেমাদাসায় তাৎপর্যপূর্ণ অ্যাওয়ে টেস্ট জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফ্লেমিং, প্রথম ও দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল যথাক্রমে ৭৮ ও ১৭৪* রানের দুটো ম্যাচ উইনিং নক৷
ফ্লেমিংয়ের আন্ডারে কিউইদের সবচেয়ে বড় সাফল্যটা ধরা দেয় ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংলিশদের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের মধ্য দিয়ে (২-১)। তারপর লারা, চন্দরপল, ওয়ালশ সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দেশের মাটিতে হোয়াইটওয়াশ করাটাও কম কৃতিত্বের ছিল না।
২০০০ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দেয় নিউজিল্যান্ড। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কিউইদের প্রথম ও একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপাটা ধরা দিয়েছিল ফ্লেমিংয়ের হাত ধরেই ৷ শুধু তাই নয়; ১৯৯৯ ও ২০০৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলাটাকেও ফ্লেমিংয়ের ক্যাপ্টেন্সি ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবেই ধরতে হবে।
২০০০-০১ মৌসুমে জিম্বাবুয়ের মাটিতে জিম্বাবুয়েকে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে নিউজিল্যান্ড৷ এরই সাথে জিওফ হাওয়ার্থকে পেছনে ফেলে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সফলতম টেস্ট অধিনায়কের (১২ জয়) আসনে বসেন স্টিভেন ফ্লেমিং।
২০০৩-০৪ মৌসুমের আগ পর্যন্ত দক্ষ নেতৃত্বগুণ দিয়ে সর্বত্র প্রশংসিত হলেও ফ্লেমিং কখনোই ঠিক স্টার পারফর্মার হয়ে উঠতে পারেন নি। নাথান অ্যাস্টল, ক্রিস কেয়ার্নস, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি কিংবা শেন বন্ডের তারকাদ্যুতির আড়ালেই পড়ে থেকেছেন সবসময়। উল্টো তাঁকে শুনতে হয়েছে টেস্ট ইতিহাসের সবচাইতে বাজে কনভার্সন রেটের অধিকারী হওয়ার দুর্নাম! ৬২ টেস্টে ফ্লেমিংয়ের সেঞ্চুরি ছিল মাত্র ২টি! অথচ পঞ্চাশ রানের কোটা পেরিয়েছিলেন আরও ৩১ বার!
সমালোচকদের মতে, ফ্লেমিংয়ের দুর্বলতা ছিল ল্যাক অব কন্সেন্ট্রেশন; সেট হয়ে উইকেট ছুঁড়ে আসতেন প্রায়ই। অহরহ শিকার হতেন সফট ডিসমিসালের। তবে সমালোচকগণ এটা ভুলে যেতেন প্রায়ই, যে নেতৃত্বের চাপ সামলেও ফ্লেমিং ব্যাট হাতে ছিলেন যথেষ্ট ধারাবাহিক। ব্যাটিং গড় সব সময়ই ছিল ৩৮-৪০ এর ভেতরে। সেঞ্চুরি বা বড় ইনিংস খুব একটা না খেললেও দলের জন্য কন্ট্রিবিউট করে গেছেন নিয়মিত।
২০০৩ সালের কলম্বো টেস্ট। উপমহাদেশের অসহ্য গরম, ধূলা আর মুরালির স্পিন থ্রেট উপেক্ষা করে ফ্লেমিং উপহার দিলেন ক্যারিয়ার সেরা ২৭৪ রানের (৪৭৬ বল) এক মহাকাব্যিক ইনিংস। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান হওয়ার সব রকম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিলেন দলীয় স্বার্থের কথা ভেবে।
একজন গ্রেট অধিনায়কের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কোথায় জানেন? একজন গ্রেট অধিনায়ক জানেন কীভাবে তাঁর দলের খেলোয়াড়দের থেকে সেরাটা বের করে আনতে হয়। ফ্লেমিংও সেটা জানতেন, হাজারটা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ৷ নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেটারদের প্লেয়ার পুল কিন্তু খুব ছোট, পাইপলাইনে ট্যালেন্টের ছড়াছড়ি এমনটা কখনোই শোনা যেত না।
হাতে গোণা নির্দিষ্ট গুটিকতক প্লেয়ারকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলাতে হত। স্টিভেন ফ্লেমিংও খুব ভালো করেই জানতেন সেটা। তিনি যেটা করতেন, প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা-দুর্বলতা নিয়ে স্টাডি করতেন, ইন ডিটেইলে। স্কিল নয়, প্রতিপক্ষকে তিনি আটকাতে চাইতেন স্ট্র্যাটেজি দিয়ে, কৌশল দিয়ে। ঠিক একজন তুখোড় দাবাড়ু যেভাবে চিন্তা করেন।
২০০১-০২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের কথাই ধরুন। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের তিনটিতেই ড্র করতে বাধ্য হয়েছিল স্বাগতিকরা। ফ্লেমিংয়ের চৌকষ বুদ্ধিমত্তা ও অব্যর্থ কৌশলের কাছে হার মানতে হয়েছিল স্টিভ ওয়াহর মত পোড় খাওয়া অধিনায়ককেও। ফ্লেমিংয়ের অভিনব ফিল্ড প্লেসিং, নির্দিষ্ট ব্যাটসম্যান ধরে ধরে সাজানো বোলিং স্ট্র্যাটেজি, প্রয়োজন অনুসারে ব্যাটিং অর্ডার শাফল করা সহ নানাবিধ কৌশলের কারণে নিজেদের চেনা হোম কন্ডিশনেও ডমিনেট করতে ব্যর্থ হয় সেরা ফর্মের অস্ট্রেলিয়া!
ফ্লেমিং জানতেন তাঁর দলের সিরিজ জেতার সামর্থ্য নেই, কিন্ত ড্র করার সামর্থ্য তো আছে! তিনি তাঁর দলকে সেভাবেই প্রস্তুত করেছিলেন এবং সেটা কাজেও করে দেখিয়েছিলেন।
ফ্লেমিংয়ের ভাষ্য ছিল, ‘আমরা শুধু নিজেদের স্কিল বা ট্যালেন্টের ওপর নির্ভর করতাম না, কারণ শক্তিশালী দলগুলোর সাথে আমরা কখনোই স্কিলে পেরে উঠব না। প্রতি মুহূর্তে চিন্তা করতাম কীভাবে প্রতিপক্ষকে আনসেটেল করা যায়। অনেক সময় অপনেন্টের দুর্বলতা খুঁজে পেতাম না, তখন চেষ্টা করতাম প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা দিয়েই তাকে ঘায়েল করার। যেমন- রিকি পন্টিং পুল-হুকে ছিল সাংঘাতিক রকমের স্ট্রং, তাকে পুল শট খেলার ফাঁদে ফেলেই অনেকবার আউট করেছি।’
টেস্ট গড় ৪০, ওয়ানডে গড় ৩২। প্রায় চারশো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেও সেঞ্চুরি মাত্র ১৭টা। হ্যাঁ, স্টিফেন ফ্লেমিং হয়ত গ্রেট ব্যাটসম্যান নন, তবে গ্রেট অধিনায়ক অবশ্যই; গ্রেট এচিভারও বটে (২৮টি টেস্ট, ৯৮টি ওয়ানডে, তিনটি টি-টোয়েন্টি জয়)। নিউজিল্যান্ডের মত একটি মাঝারি মানের দল নিয়ে তিনি যা করেছেন, তার জন্য ফ্লেমিংয়ের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।