স্পিন গ্রেটনেসের সর্দারজি

খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন বরাবর। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি জীবনে। ভারতীয় ক্রিকেটে ১৩ বছর ধরে রাজত্ব করে যাওয়া এই দুরন্ত স্পিনার, এই দোর্দন্ডপ্রতাপ খেলোয়াড় এবং ঠোঁটকাটা মানুষটাকে একটু একটু করে ভুলে গেছে দেশ।

সে কতকাল আগের কথা! ক্রিকেটবল যে টকটকে লাল ছাড়া অন্য রঙের হতে পারে তখনও তা মানুষের কল্পনার বাইরে। ক্রিকেট তখনও ধোপদুরস্ত সাদা জামাপ্যান্টের খেলা। শীতকাল জুড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাঁচদিনের খেলা। মাঝে আবার একটা রেস্ট ডে।

আমরা তখন একটু একটু করে ক্রিকেট বুঝছি। ভারত তখন অনেক হারতো আর মাঝেমধ্যে জিতে ফেলত। সেটাই ছিল দস্তুর আর আপামর ভারতবাসী তাতেই খুশি। গোটা পাড়ায় খুঁজেপেতে একটা কী দুটো বাড়িতে টিভি তখন। সেও সাদাকালো। কখনও সখনও দেশের মাটিতে চলা টেস্টম্যাচের সম্প্রচার হত তাতে। বিদেশের মাটিতে হলে সেই রেডিও ভরসা।

তখন ভারতীয় ক্রিকেটে লিটল মাস্টারদের যুগ। গাভাসকার-বিশ্বনাথের যুগলবন্দী। উইকেটের পিছনে দীর্ঘ কিরমানী-দশক। সেই লিলি-টমসন, হোল্ডিং-গার্নার, ইমরান-সরফরাজের আগুনঝরানো ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে তখন টিমে হাতেগোনা জনাচারেক ব্যাটসম্যান। ভারতে তখনও মিডিয়াম পেসারের যুগ। ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটারের উপর গতিতে বল করার কথা ভাবতেও পারত না মদনলাল-ঘাউড়ির জুটি।

তাহলে বড়াই করার মত কিছুই কী ছিল না আমাদের? ছিল। বিশ্বমানের চার স্পিনার ছিল আমাদের যাদের দৌলতে মাঝেমধ্যে আমরাও টেস্ট জিতে ফেলতাম।

আর সেই স্পিন অ্যাটাকের পুরোভাগে ছিল এক সর্দারজী। চোখ বন্ধ করলে এখনও ছোটবেলার ক্রিকেটস্মৃতিতে ফুটে ওঠে সেই পাঞ্জাবী যুবকের বোলিং অ্যাকশন।

যে কোনও টেস্ট ম্যাচে মোটামুটি প্রথম দশ-বারো ওভার পেরোলেই তখন মদন-ঘাউড়ির ছুটি। তারপর পালিশ না ওঠা প্রায় নতুন বল নিয়েই একপ্রান্ত থেকে সেই সর্দারজী আর অন্য প্রান্ত থেকে তার যে কোনও এক দোসর, চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন বা বেঙ্কটরাঘবন। ঘন্টার পর ঘন্টা চলত নিরবচ্ছিন্ন স্পিন আক্রমণ!

সর্দারজী ওরফে বিষেণ সিং বেদীর কোঁচড়ে জমা হত একের পর উইকেট। সেই ভরপুর পেসবোলিংয়ের যুগে ৬৭টা টেস্টে ২৬৬টা উইকেট মুখের কথা ছিল না! সেই ছন্দময় বাঁহাতি অ্যাকশনের জাদুর সামনে দীর্ঘ বারোবছর ধরে হিমশিম খেয়েছে পৃথিবীর তাবড় ব্যাটসম্যানরা।

একা একজন বোলারের দাপটে ম্যাচ বা সিরিজ জেতার শুরু সেই তখন থেকে। তা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কলকাতায় ৯৮ রানে ৭ উইকেট হোক বা পার্থের মাটিতে ১৯৪ রানে ১০ উইকেট হোক।

যে কয়টা মুষ্টিমেয় একদিনের ম্যাচ খেলেছিলেন (তখন ৬০ ওভারের হত) তাতেও ছাপ রেখেছিলেন। ১৯৭৫য়ের বিশ্বকাপে ইস্ট আফ্রিকার বিরুদ্ধে ম্যাচে তাঁর পরিসংখ্যান ১২ ওভার – ৮ মেডেন – ৬ রানে ১ উইকেট ছিল জীবনের সেরা ওয়ান-ডে বোলিং।

আসল কথা হল তাঁর সময়ের বিশ্বসেরা স্পিনার ছিলেন বেদী। সুনীল গাভাসকারের সঙ্গে তাঁর নাম একইসঙ্গে নেওয়া হত বিশ্বসেরা ক্রিকেটারদের তালিকায়।

পরবর্তীতে ছিলেন ক্রিকেটের সেরা কঠিন সমালোচক। যা মনে হত সোজাসাপটা বলে দিতেন মুখের উপর। সে মুরলীধরনকে চাকার বলা হোক বা সিরিজ হারের পর গোটা ভারতীয় টিমকে ‘সমুদ্রে ফেলে দিতে চাওয়া’ হোক!

এক তুমুল বিতর্কিত চরিত্র হলেও ভারতীয় ক্রিকেটের অমঙ্গল চাননি কখনও। খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন বরাবর। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি জীবনে। ভারতীয় ক্রিকেটে ১৩ বছর ধরে রাজত্ব করে যাওয়া এই দুরন্ত স্পিনার, এই দোর্দন্ডপ্রতাপ খেলোয়াড় এবং ঠোঁটকাটা মানুষটাকে একটু একটু করে ভুলে গেছে দেশ।

তাই হয়ত এই দশ-কুড়ি ওভারের সাদা, গোলাপী বলের ক্রিকেটের যুগে, চিয়ারগার্লদের নাচ আর আতসবাজির সার্কাসক্রিকেটের যুগে, এককালের ভারতসেরা স্পিনার, বিপক্ষের ত্রাস নিঃশব্দে চলে যান শরতের হিমটুকু মাথায় নিয়ে।

বিষেণ সিং বেদীরা চলে যান এভাবেই। শুধু বাইশগজে তাঁর ঘূর্ণীর ইতিবৃত্ত যাদের ক্রিকেট শিখিয়েছিল কোনও শৈশব-কৈশোরে, তাদের ঝলমলে উৎসব-সন্ধ্যাতেও একটু মন খারাপ হয়। জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত স্মৃতিতে ধরা থাকে কেবল। ইউটিউবে তাদের খুঁজলেও পাওয়া যায় না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...