চিরকালীন ফেবারিট ব্রাজিল

বিশ্বকাপ এবং ব্রাজিল যেন এক বৃন্তে গাঁথা দুই ফুল। ‘গ্রেটেস্ট শো আর্থ’ আসরে ব্রাজিল চিরকালীন ফেবারিট। মাঠের বাইরে যাই ঘটুক, ফর্ম যাই বলুক- ব্রাজিল বিশ্বকাপ শুরু করে ফেভারিট হিসেবেই। দুই যুগ পর বিশ্বকাপ আয়োজিত হচ্ছে এশিয়াতে। জাপান এবং কোরিয়ার সর্বশেষ সেই আসরের চ্যাম্পিয়ন দলটার নাম কিন্তু ব্রাজিল। 

ছয় বছর আগে ব্রাজিলের দায়িত্ব নেবার সময়ই কোচ তিতে জানিয়েছিলেন তাঁর মূল লক্ষ্য বিশ্বকাপ জয়। ঘরোয়া ফুটবলের সকল ট্রফি জিতলেও অধরা বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে ক্যারিয়ায়রকে পূর্ণতা দিতে চান তিনি। ২০১৮ বিশ্বকাপে কাসেমিরোর অনুপস্থিতি এবং অদম্য এক বেলজিয়ামের কাছে হেরে বাদ পড়তে হয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে চার বছর পর আরও পরিণত ব্রাজিল। এবারের বিশ্বকাপের পর জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেবার ঘোষণা আগেই দিয়েছেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে নিজের শেষ বিশ্বকাপটা রাঙিয়ে দেবার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবেন ‘দ্য প্রফেসর’। 

দুঙ্গা কিংবা মানো মেনেজেসের আমলে সমালোচনা ছিল ব্রাজিল তাঁদের চিরায়ত সাম্বা স্টাইলে খেলছে না। তিতে ফিরিয়ে এনেছেন সেটা, নিজেদের মজ্জাগত আক্রমণাত্নক ফুটবল দেখা যাচ্ছে ব্রাজিলের খেলায়। কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হারলেও সরে আসেননি নিজের দর্শন থেকে। বরং গত কয়েক মাসে গুছিয়ে নিয়েছেন দলকে। বিশ্বকাপ- আসল লক্ষ্য তো সেটাই।

গোলরক্ষক থেকে আক্রমণ – সবখানেই বিশ্বসেরা সব তারকাদের ছড়াছড়ি ব্রাজিল দলে। সাবেক বার্সা এবং ডাচ কোচ রোনাল্ড কোম্যান তো সাধে বলেননি, ‘ব্রাজিল চাইলে বিশ্বকাপ দলে ৮০ জন খেলোয়াড়ও ডাকতে পারে।’  এডারসনের কথাই ধরুন না, বিশ্বের অন্যতম সেরা দল ম্যানচেস্টার সিটির গোলবার সামলান তিনি। গত মৌসুমে জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগের সেরা গোলরক্ষকের খেতাব, অথচ জাতীয় দলে প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক নন তিনি।

সেলেসাওদের গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে বহু আগেই নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছেন অ্যালিসন বেকার। একই দশা রক্ষণভাগ কিংবা মিডফিল্ডেও, ডিফেন্সে থিয়াগো সিলভার সাথে জুটি বাঁধবেন মার্কুইনহোস কিংবা এডার মিলিটাও। মিডফিল্ডে কাসেমিরো এবং লুকাস পাকুয়েতার জায়গা পাকা, তাঁদের সাথে প্রতিপক্ষ বিবেচনায় যোগ দেবেন ফ্রেড, এভারটন, ফ্যাবিনহো, ব্রুনো গুইমারেসরা।

লাতিনের খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার মূলত ত্রিশের পরই শেষ হতে শুরু করে। আশ্চর্যজনক কিছু না ঘটলে চোটজর্জর নেইমারের এটাই শেষ বিশ্বকাপ। নিজের শেষ বিশ্বকাপটা জিতে তিনি বসতে চাইবেন পেলে, গারিঞ্চা, রোমারিও, রোনালদোদের পাশে। তবে এবার খানিকটা নির্ভার হয়ে খেলতে পারবেন তিনি। গত দুই বিশ্বকাপের তুলনায় ব্রাজিলের আক্রমণভাগ এবার বেশ ভারসাম্যপূর্ণ। আগের বিশ্বকাপগুলোতে নেইমার একা টেনেছেন ব্রাজিলকে, গোল করা কিংবা করানোর দায়িত্ব পুরোটাই ছিল তাঁর কাঁধে।

এবারও দলের মূল তারকা তিনি হলেও, পাশে পাবেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র, অ্যান্থনি, রাফিনহা, রদ্রিগো, গ্যাব্রিয়েল জেসুসদের মত তারকাদের। বিশেষ করে ভিনিসিয়াস জুনিয়র আছেন উড়ন্ত ফর্মে, রিয়াল মাদ্রিদে করিম বেনজামার সাথে জুটি গড়ে জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। গত কয়েক মাসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকেই সুযোগ দিয়েছেন তিতে, ফলে তাঁদের নিজেদের মাঝে বোঝাপড়া বেশ ভাল। বিশেষ করে বিশ্বকাপে পাকুয়েতা-নেইমার জুটি বাকি দলগুলোর ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারেন। 

তবে এবারের বিশ্বকাপ দলে ব্রাজিলের এক্স ফ্যাক্টর হতে পারেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। ২০১৮ বিশ্বকাপের দুঃস্বপ্ন ভুলতে গত চার বছর ধরে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, এই মৌসুমে বেশি ম্যাচ খেলার আশায় ম্যানসিটি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন আর্সেনালে। এমিরেটসে আর্তেতার অধীনে আরও শাণিত করেছেন নিজেকে, হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। তাছাড়া তিনি প্রথাগত স্ট্রাইকারদের মত বক্সে বলের আশায় থাকেন না, নিচে নেমে বল তৈরি করা কিংবা কেড়ে নিতেও তিনি সমান পারদর্শী। ক্লাবের ফর্মটা যদি তিনি জাতীয় দলেও টেনে আনতে পারেন, তাহলে বলাই বাহুল্য এবারের বিশ্বকাপটা হতে যাচ্ছে ব্রাজিলেরই। 

চাঁদের বুকে যেমন কলঙ্ক আছে, তেমনি এবারের ব্রাজিল দলেও রয়েছে দুর্বলতা। ব্রাজিল বরাবরই উপহার দিয়েছে অসাধারণ সব ফুলব্যাক, রবার্তো কার্লোস, কাফু, কার্লোস আলবার্তোরা ফুলব্যাক পজিশনে উপহার দিয়েছেন অসাধারণ সব মূহুর্তের। কিন্তু দানি আলভেস এবং মার্সেলোর বিদায়ের পর তাঁদের কাছাকাছি মানের ফুলব্যাক পায়নি ব্রাজিল।

লেফটব্যাকে তবু রেনান লোদি, অ্যালেক্স সান্দ্রো এবং অ্যালেক্স টেলেসের মত অপশন থাকলেও রাইটব্যাকে সেই বিলাসিতা নেই। সবেধন নীলমণি সেই এমারসন, দানিলো, গিলবার্তোদের মত গড়পড়তা মানের ফুটবলাররা।  একারণে ভিনিসিয়াস কিংবা রাফিনহাদেরও খানিকটা নিচে নেমে সাহায্য করতে হবে ফুলব্যাকদের, অন্যথায় নক আউট পর্বে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে ব্রাজিলের। 

২৫ নভেম্বর সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে এবারের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবে ব্রাজিল। সুইজারল্যান্ড এবং ক্যামেরুনকে নিয়ে গড়া গ্রুপ-জি থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের রাউন্ডে উঠতে সমস্যা হওয়ার কথা না ব্রাজিলের। দ্বিতীয় রাউন্ডে তুলনামূলক সহজ দল পেলেও, কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের সম্ভাবনা আছে স্পেন-জার্মানির মত দলের মুখোমুখি হওয়ার। তবে ব্রাজিলের সে নিয়ে ভাবনা থাকার কথা না, সেরা হতে গেলে তো সেরাদের হারিয়েই হতে হয়। এখন দেখার বিষয় কাতার বিশ্বকাপ জিতে নিজেদের হেক্সা মিশন সম্পন্ন করতে পারেন কিনা নেইমার-ভিনিসিয়াসরা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link