বিজয়ী সিংহাসনে যুবরাজ

খেলায় রেকর্ড হয় ভাঙার জন্য। কেউ না কেউ রেকর্ড ভাঙবেন।

তারপরও কিছু রেকর্ডকে খুব টেকসই ধরা হতো বা হয়। এই যেমন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের গড়। তেমনই ছিলো গ্যারি সোবার্সের ৩৬৫ রানের ইনিংস। অনেকেই মনে করতেন, এই রেকর্ড আর ভাঙা সম্ভব হবে না। কিন্তু সেটাকে পরে এক সময় টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন ব্রায়ান লারা, হেইডেনরা।

এই রেকর্ড ভেঙেই ব্রায়ান লারা ‘লারা’ হয়ে ওঠেন।

গ্যারি সোবার্সের এই রেকর্ড প্রথমবারের মত ভেঙে ছিলেন তারই স্বদেশি ক্রিকেটে বরপুত্র ব্রায়ান লারা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই রেকর্ড গড়েন তিনি।

সময়টা ১৬ এপ্রিল, ১৯৯৪ সাল। সিরিজের পঞ্চম এবং শেষ টেস্টে মুখোমুখি হয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ড। সিরিজে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম তিন টেস্ট জিতে সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চতুর্থ টেস্টে বার্বাডোজে জয় পেয়ে খেলা জমিয়ে তোলে ইংল্যান্ড। আর ৫৯ বছর পর বার্বাডোজের মাটিতে প্রথম কোনো বিদেশী দল হিসেবে ম্যাচ জেতায় কিছুটা আত্মবিশ্বাসী ছিলো ইংল্যান্ড। তাই অ্যান্টিগাতে শেষ টেস্ট জিতে কিছুটা সন্মানের সাথে বাড়িতে ফেরার আশায় মাঠে নেমেছিলো ইংল্যান্ড।

ইংল্যান্ড দলের অ্যান্টিগাতে শেষ টেস্ট জয়ের আশায় পানি ঢেলে দেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা। এই টেস্টে তাঁর পূর্বসূরী স্যার গ্যারি সোবার্সের করা অপরাজিত ৩৬৫ রানের ইনিংসকে ছাড়িয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৩৭৫ রানের রেকর্ড গড়েন তিনি।

অ্যান্টিগাতে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক কোর্টনি ওয়ালশ। কিন্তু শুরুতেই দুই ওপেনার ফিল সিমন্স এবং স্টূয়ার্ট উইলিয়ামস ফিরে যাওয়ায় কিছুটা বিচলিত হয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এই অবস্থার ত্রাণ কর্তা হয়ে দাড়ান ব্রায়ান লারা এবং জিমি অ্যাডামস।

প্রথম দিন শেষে ১৬৪ রানে অপরাজিত থেকে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন ব্রায়ান লারা। দিন শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ছিলো তিন উইকেটে ১৭৪ রান। অথচ দিনের শুরুতেই দুই উইকেট হারিয়েছিলো ওয়েস্ট। পরে সারাদিনে মাত্র এক উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

১৬৪ রানে অপরাজিত থেকে দ্বিতীয় দিনে মাঠে আসেন ব্রায়ান লারা। এখান থেকে দিনের শেষে নিজের স্কোরকে নিয়ে যান ৩২০ রানে। ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে মাত্র এক উইকেট শিকার করতে পারেন। ইংল্যান্ডের বোলাররা শিকার করেছিলেন ব্রায়ান লারা বিপক্ষে তাঁরা তাঁদের সব রকমের পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছিলেন। তাঁরা শুধু অপেক্ষায় ছিলো কখনো লারা কোনো ভুল করবে এবং লারাকে আউট করবে।

দ্বিতীয় দিনে কেইথ আর্থারটন প্যাভিলিয়নে ফিরে যাবার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঐ সিরিজেই অভিষিক্ত হওয়া শিব নারায়ণ চন্দরপাল। তিনি একপাশে দূর্দান্ত ব্যাটিং করছিলেন আর অপরদিক ছিলেন চন্দরপাল।

চন্দরপাল লারার এই ইনিংস সম্পর্কে জানান, ক্যারিয়ারে এদিনই লারাকে সবচেয়ে বেশি মনযোগী দেখেছিলেন এবং সে রেকর্ড সম্পর্কে জানতেন তিনি। ড্রেসিংরুমে প্রচুর অভিনন্দন বার্তা আসার পরও সে তাঁর মনযোগ হারাননি।

৩২০ রানে তৃতীয় দিন ক্রিজে আসেন ব্রায়ান লারা। এই দিন তিনি স্যার গ্যারি সোবার্সের অপরাজিত ৩৬৫ রানের ইনিংসকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ রানের শিখরে বসেন ব্রায়ান লারা। ক্রিস লুইসকে স্কয়ার লেগ অঞ্চল দিয়ে চার মেরে গ্যারি সোবার্সকে ছাড়িয়ে যান। সাথে সাথে মাঠে দৌড়ে আসেন মাঠের দর্শকরা এবং গ্যারি সোবার্স নিজে।

সর্বোচ্চ রান এই রেকর্ড টিকে ছিলো প্রায় এক দশক। পরবর্তীতে স্বল্প সময়ের জন্য এই রেকর্ড নিজের নামে করে নেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ম্যাথু হেইডেন। ম্যাথু হেইডেনের এই রেকর্ড ভাঙ্গার ছয় মাসের মাথায় এই রেকর্ড আবারো নিজের করে নেন ব্রায়ান লারা। যা কিনা এখনো অক্ষত আছে।

তৃতীয় দিনের শুরুতে খেলায় নির্ভার থাকার জন্য সকালে নয় হোল গলফ খেলে মাঠে এসেছিলেন ব্রায়ান লারা। গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড ভাঙার পর আর বেশিক্ষণ মাঠে থাকতে পারেনি তিনি।

 

৩৭৫ রানে অ্যান্ড্রু ক্যাডডিকের বলে জ্যাক রাসেলের কাছে ক্যাচ দেন লারা। রাসেল এই সুযোগ মিস করেননি, আর এর মাধ্যমেই সম্পাত্তি ঘটে লারার এই ইনিংসের।

এই ইনিংসের স্থায়ীত্ব ছিলো ৭৬৬ মিনিট (১২ ঘন্টা ৪৬ মিনিট) এবং এই ইনিংস খেলার জন্য ৫৩৮ বল মোকাবিলা করেন তিনি। এছাড়াও এই ইনিংসে ছিলো ৪৫ বাউন্ডারি। যার মধ্যে কোনো ছক্কা ছিলো না।

এতো সুন্দর এবং দুর্দান্ত ইনিংসের পরও এটা লারার সেরা ইনিংস নয়। কারণ তিনি এই অ্যান্টিগাতেই ৪০০ রানে অপরাজিত ছিলেন। ব্রিজটাউনে খেলেছিলেন ১৫৩ রানের ইনিংস। এই রকম সব সুন্দর ইনিংসের পর সব লারার সব ইনিংসকেই সেরা মানতে হবে। এমনকি অনেকের মতে এই ইনিংসে সেই ইতিহাস গড়া ৪০০’র থেকেও সুন্দর!

ইনিংসটা দেখে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান অ্যালেক স্টুয়ার্ট বলেছিলেন, ‘আমি যাদের বিপক্ষে খেলেছি, তাঁদের মধ্যে লারাই ছিল। শচীন টেন্ডুলকার নাকি লারা – এই প্রশ্নে আমি আগে নিজের চুল ছিড়তাম, কিন্তু সব সময়ই লারাকে ওপরে রাখি। কারণ, ও জানে কিভাবে কোনো বোলিংকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিতে হয়। মাত্রই যেখান থেকে আপনি ফিল্ডার সরাবেন, লারা ঠিক ওখানটাতেই মারবে। ওর রান করার ক্ষুধা প্রতিপক্ষের হাতে কোনো বিকল্প উপায় রাখতে দেয় না।’

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link