এক ক্যাচের এক দানব

দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি, তাঁর হাতের ডান পাশে দিলেন এক লাফ। লাফ দিয়ে লুফে নিলেন এক হাতের এক দূর্দান্ত ক্যাচ। ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বারমুডার সেই খেলোয়াড়ের কথা কি মনে আছে। বিশাল দেহি এক খেলোয়াড় ফিল্ডিং করছিলেন প্রথম স্লিপে। ডোয়েন লেভেরক সে বিশ্বকাপের সব আলো যেন কেড়ে নিয়েছিলেন নিজের দিকে।

এরপর সেই খেলোয়াড়ের কি হয়েছে তাঁর আর কেউ খোঁজ করেনি। প্রয়োজনও পড়েনি। আসলে প্রয়োজন মনে করেনি। বারমুডা আইসিসি সহযোগী দেশগুলোর একটি। এক বিশ্বকাপ ছাড়া তাঁদের আর আলোর মুখ দেখার সুযোগ হয়না। তবে দিনদিন সে সুযোগও হচ্ছে ক্ষীণ। সে এক অন্য আলাপ। আবার ফিরি ডোয়াইন লেভেরকের গল্পে ফিরি।

২০০৭ সালে প্রথমবারের মত আয়োজিত হয়েছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তবে তার আগে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আয়োজিত হয়েছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ। পোর্ট অব স্পেনে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল ক্রিকেট পাড়ার একেবারে শৈশব কাটানো বারমুডা। সেদিন কি অনবদ্য ব্যাটিংটাই না করেছিল ভারত! ৪১৩ রান তুলেছিল তাঁরা।

অনভিজ্ঞ বারমুডা বোলিং আক্রমণকে কোন পাত্তাই দেয়নি ভারতের ব্যাটাররা। বীরেন্দ্র শেবাগের মারকুটে শতকে পর যুবরাজ সিংয়ের পঞ্চম গিয়ারের ৮৩। সেই সাথে সৌরভ গাঙ্গুলির ধৈর্য্যশীল ৮৯। এসব মিলিয়ে বিশাল এক সংগ্রহ জড়ো করে ভারত। তবে এসবকিছু ফিঁকে হয়ে যায় একটি ক্যাচের কাছে। অদ্ভুত এক ক্যাচ! অপ্রত্যাশিত শারীরিক সক্ষমতার উদাহরণ!

ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বল। ব্যাটিং প্রান্তে তখন রবিন উথাপ্পা। বারমুডার হয়ে বোলিংয়ে তখন মালাচি জোনস। তবে তাঁর আগেই নিজের অবস্থান নিয়ে আলাপ সেড়ে ফেলেছিলেন লেভেরক। তিনি বলেন, ‘বোলার সেই ওভারে বল করার আগেই আমি আমার উইকেটরক্ষকের সাথে আলোচনা করে নিয়েছিলাম যে আমি আমার ডান দিকে একটু সড়ে দাঁড়াব। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল কিছু একটা আসতে চলেছে। তাছাড়া রবিন উথাপ্পার থার্ড ম্যান অঞ্চল দিয়ে রান বের করবার প্রবণতা রয়েছে।’

তারপর সেই বাইশ গজের পেছনে যা হয়েছে তা তো রীতিমত মানুষকে মুগ্ধ করেছে। লেভেরক বেশ স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি। ক্রিকেটের পরিভাষায় আনফিট বলতে যা বোঝায়। প্রায় ১২৭ কেজি ওজনের এক মানুষ তিনি। তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশাটা সাধারণত খুবই স্বল্প। তবে তিনি সেদিন যা করে দেখিয়েছিলেন তা এখনও যেন সদ্যই শিল্পীর হাতের আঁচড় পাওয়া কোন শিল্পকর্ম। স্মৃতিতে স্পষ্ট।

জোনসের অফস্ট্যাম্পের বাইরের এক বলে। শুরু থেকেই খানিকটা নড়বড়ে থাকা উথাপ্পা সেই বল খোঁচা দিয়ে দিক পরিবর্তন করে দেন। কিন্তু আগে থেকেই ওঁত পেতে থাকা লেভেরক নিজের শরীরটা এককথায় ছুঁড়ে দিলেন বলের দিকে। কেউ হয়ত ভাবেওনি যে তিনি ঠিক সে পরিমাণ লাফ দিতে পারবেন। তবুও দিলেন তিনি। আর তাঁর থেকেও অবাক করা কাণ্ড সেই বল আটকা পড়লো তাঁর হাতের মুঠোয়।

ব্যাস! মাটিতে লুটে পড়া লেভেরক উঠেই দিলেন এক ভোঁ দৌড়। তাঁর সতীর্থরাও ছুটলেন তাঁর পিছু। কিন্তু তাঁকে কি আর ধরে ফেলা যায়? ধারাভাষ্যকাররাও অবাক। মূলত তাঁর ফিটনেস এবং বয়সই অবাক হওয়ার পেছনের কারণ। ৩৫ বছর বয়সে তিনি এসেছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকাপে। অথচ সে সময়ে অধিকাংশ ক্রিকেটার পৌঁছে যান নিজের ক্যারিয়ারের গোধুলি লগ্নে।

তারও বছর দুয়েক বাদেও তিনি খেলেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। নেদারল্যান্ডের সাথে ছিল তাঁর শেষ ম্যাচ। তাও আবার ২০০৯ সালে। এরপর ক্রিকেট থেকে আড়াল চলে যান তিনি। এর আগে অবশ্য এই অফ স্পিনারের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে মোট ৩৪টি আন্তর্জাতিক উইকেট। তবে ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও আজন্ম তরুণ ক্রিকেটার খেলাধুলো থেকে দূরে সড়ে জাননি।

তিনি এরপর বেশকিছুদিন যুক্ত ছিলেন গলফের সাথে। সেখানে কেভিন পিটারসনের মত খেলোয়াড়ের সাথেও গলফ খেলার স্মৃতি তৈরি হয়েছে তাঁর। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এখন যুক্ত হয়েছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে। মূলত একজন জেলার এবং পুলিশ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ আর বাকি ক্রিকেটারদের মতোই উজ্জ্বল এক ক্যারিয়ার পার করতে পারতেন তিনি।

কি দূর্দান্ত এক বোলিং রেকর্ড নিয়ে নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা শেষ করেছিলেন তিনি। ৩২ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে তিনি রান দিয়েছেন ৪.০০ ইকোনমি রেটে। বোলিং গড়টা চলনসই। ৩৩.০২ গড়ে তিনি বোলিং করেছেন তাঁর বছর তিনেকের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে।

সহযোগী দেশগুলোর খেলোয়াড়েরা হয়ত এমন করেই হারিয়ে যায়। তাঁদের খবর আর কেউ রাখে না। সে দুই একটি বিশ্বকাপই যেন তাঁদের ভরসা। তবুও কত কাঁটাছেঁড়া। আইসিসির যেন কোন বাড়তি পরিকল্পনা নেই ক্রিকেটকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার। নতুবা সময়ের অভাবের ডোয়াইন লেভেরকের মত প্রবল ইচ্ছাশক্তিও কালের গর্ভে আড়াল হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link