দিনবদলের গানটা যেনো সুরেলা হয়

‘এটা পেশাদার জগৎ। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমি পেশাদারীভাবেই নিচ্ছি এটাকে। আর কিছু বলার নেই।’

– মাশরাফি বিন মুর্তজা

দল ঘোষণার আগে নিজের অবস্থান উপস্থাপনের সুযোগ ছিল তার জন্য কেবল বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ। সেখানে তার যা করার ছিল, তিনি করেছেন। অনেকের ধারণার চেয়ে বেশি করেছেন। নির্বাচকরা তাকে বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছেন ভবিষ্যতে তাকানো, তরুণদের জায়গা দেওয়া, ২০২৩ বিশ্বকাপের ভাবনা। এখানে মাশরাফির কিছু করার নেই। বাদ পড়ার পর তার এই ছোট্ট প্রতিক্রিয়া তাই সম্ভবত যথার্থই।

তাকে দলে রাখলে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকত। বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষেও যুক্তি আছে। মূল ব্যাপারটি হলো, যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা নিজেদের কাছে কতটা পরিস্কার ও ভাবনায় কতটা অটল।

আজ নির্বাচকরা যে কারণগুলো বলেছেন, সেগুলোর সঙ্গে কেউ একমত হোক বা না হোক, ভাবনাগুলোর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি অন্তত আছে। সেটার জন্য সাধুবাদ। কিন্তু বোর্ড সভাপতি গত কিছুদিনে বা নানা সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে ধরণের কথা বলেছেন, তাতে সন্দেহ-সংশয়-প্রশ্নের অবকাশ থাকেই। বিশেষ করে বোর্ডের কিছু কর্তা যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফোন করে বলেন মাশরাফিকে বাদ দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে, বিরুদ্ধে নিউজ করতে, তখন প্রশ্ন উঠে যায়, তাদের ভাবনা কতটা সৎ ও ক্রিকেটীয়।

যাই হোক, বাস্তবতা হলো তিনি এখন আর দলে নেই এবং দল সামনে তাকাচ্ছে। আপাতত অফিসিয়াল কারণগুলোতেই ভরসা রাখা যাক। যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এসব উপহাসের মতো শোনায়। তার পরও নির্বাচক কমিটি, টিম ম্যানেজমেন্ট বলেছে নতুন বছরে নতুন শুরুর কথা। সেই আশ্বাসে ভরসা রাখলাম।

আশা করি, সত্যিকার অর্থেই পরিকল্পনার ছাপ দেখতে পাব, দল এগিয়ে যাবে। মাশরাফির নেতৃত্বে ৫০ ওয়ানডে জিতেছে বাংলাদেশ, ভবিষ্যতের অধিনায়কেরা এটিকে নতুন উচ্চতায় তুলে নেবেন। বিশ্ব সেরার ট্রফি আসবে দেশে। আশা করি, ভবিষ্যতের সঙ্গে বর্তমানের সমন্বয় ভালোভাবে করা হবে। ২০২৩ বিশ্বকাপে দল সরাসরি কোয়ালিফাই করতে পারবে। বিশ্বকাপের জন্য দল গোছাতে গিয়ে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা হারাতে হবে না। আশা করি, তাকে বাদ দেওয়ার যে মানদণ্ড বলা হয়েছে, সবার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে।

তরুণ যাদেরকে সুযোগ দেওয়া হবে, তাদের ক্ষেত্রে আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্ববোধের প্রমাণ রাখবেন। তরুণ যাকে বা যাদেরকে নেওয়া হবে, সংবাদমাধ্যম ও সমর্থকদের দায়িত্ব হবে দ্রুতই তাদেরকে মাশরাফির সঙ্গে তুলনা না করা। সময় দেওয়া। নির্বাচক কমিটি ও টিম ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব, সঠিক প্রতিভা বাছাই করা ও তাকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া।

আর হ্যাঁ, ৬-৮-১০-১১ বছর ধরে খেললেও এখনও যেসব পেসার বা ক্রিকেটারদের ওপর দল নির্ভর করতে পারে না, সেই জায়গায় যারা নিজেদের নিতে পারেননি, তাদের দায়িত্ব নির্ভরতার জায়গায় নিজেদের নিয়ে যাওয়া। সত্যিই যদি নতুনভাবে দলের পথচলা শুরু হয়, সেই পথের সারথী হতে হবে। আগের কদু থেকে এখন লাউ হলে বিপদ, জাদু হতে হবে।

২০১৯ বিশ্বকাপের পর কিংবা বাদ পড়ার আগেই মাশরাফির অবসর নেওয়া উচিত ছিল যারা বলছেন, আমার মনে হয়, এই আলোচনার মূল্য খুব একটা নেই। অনেক আগেই সেই অধ্যায় শেষ। মাশরাফি তো সব পরিস্কারই করে দিয়েছেন!

মাশরাফির মতো একজনকে নিয়ে ক্রিকেট অনুসারীদের ব্যক্তিগত নানা ভাবনা থাকবেই। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম, বিশ্বকাপ শেষেই যেন তিনি অবসর নেন। যেটুকু মেশার বা কথা বলার অধিকার আছে, সেটা থেকে তাকে তখন বলেছিও। আবার, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও আমি তাকে দলে দেখতে চেয়েছিলাম। কারণ, আমি নিশ্চিত, তিনি পারফর্ম করতেন এবং দলে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতেন। এই সবই আমার ব্যক্তিগত মতামত, ভাবনা। সাংবাদিকতার জায়গায় ব্যক্তিগত ভাবনা চাপানোর সুযোগ নেই। এরকম ব্যক্তিগত ভাবনা ও মতামত দেশের কোটি ক্রিকেট অনুসারীরও অবশ্যই আছে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি নিজে কী ভাবছেন। তার পরিবার ও কাছের মানুষরা কী ভাবছে। বিশ্বকাপের পর তিনি খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নেতৃত্ব ছাড়ার পর খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেসবের পেছনে কারণ ছিল, ভাবনা ছিল। সেগুলোকেও আমি সম্মান করেছি, অনুধাবন করেছি, অনুভব করেছি। আমার মনে হয়, তার সত্যিকারের ভক্তদেরও সেই উপলব্ধি থাকা উচিত।

নেতৃত্ব ছাড়ার পর যখন খেলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা তিনি দিলেন, যে কোনো সময় বাদ পড়ার মানসিক প্রস্তুতিও তার তখন থেকেই নিশ্চয়ই ছিল। তিনি জানতেন, প্রায় প্রতি ম্যাচেই পারফর্ম করতে হবে। এক ম্যাচ খারাপ করলেই খড়গ নেমে আসবে। তবু চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জে জয় কিংবা হার, কোনোটির সুযোগই পেলেন না। তিনি সেটিকে পেশাদারী দৃষ্টিতে দেখছেন। এটাই তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল।

বোর্ড প্রধান নানা সময়ে বলেছেন, তার জন্য বিদায়ী ম্যাচের আয়োজন করতে চান। ভালো কথা। কিন্তু সেটার পেছনে যদি অন্য উদ্দেশ্য থাকে, যদি হম্বিতম্বি করে বলা হয়, ‘২ কোটি টাকা খরচ করে বিদায়ী ম্যাচ আয়োজন করছি, অমুক করছি, তমুক করছি’ এটায় তিনি কেন সায় দেবেন? তার চরিত্র, ধরনের সঙ্গে এটা যায়? আত্মসম্মান বোধ নেই তার?

হ্যাঁ, দেশের ক্রিকেটের মহানায়ককে সাড়ম্বরে বিদায় জানানো, উথালপাথাল আবেগে শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছা অনেকের থাকা স্বাভাবিক। না পারলে আক্ষেপও হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মতে, তার চেয়েও বেশি জরুরি, তাঁর ভাবনাকে সম্মান করা। তিনি স্রেফ খেলতে চেয়েছেন। তিনি বলেননি, তাকে দলে নিতেই হবে।

অনেককেই দেখছি, ফেসবুকে লিখছেন, নানা জায়গায় বলছেন যে মাশরাফি নাকি ছ্যাঁচড়ামো-ছ্যাবলামা করছেন। অথচ জোর করে দলে রাখার মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, এজন্য কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, নেতৃত্ব ছেড়েছেন। অনেকবার স্পষ্ট করে এটাও বলেছেন, জাতীয় দলে না নেওয়া হলেও সমস্যা নেই, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলবেন। একজন খেলোয়াড় আর কী করতে পারেন!

একমাত্র চাপ ছিল সম্ভবত তার পারফরম্যান্স। এই যে এতদিন পর খেলতে নেমে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে ভালো বোলিং করলেন, তৃতীয় ম্যাচেই পাঁচ উইকেট নিলেন, এসবই ছিল চাপ। ভালো চাপই তো, নাকি ভালো বোলিং করাও ছ্যাঁচড়ামো?

যাই হোক, নির্বাচকরা ভবিষ্যৎ ভেবেছেন। খুব ভালো। মাশরাফি অনেক আগেই বলেছেন, বাকি যতদিন খেলবেন, আনন্দ নিয়ে খেলতে চান, মনের খোরাক মেটাতে চান। এটুকু অধিকার শুধু তার মতো কিংবদন্তির কেন, যে কোনো খেলোয়াড়ের আছে। সেখানেও কেউ তাকে শূলে চড়াতে চাইলে বুঝতে হবে, সেই চাওয়ায় কেবল ব্যক্তিগত ক্রোশ-দ্বেষই আছে।

ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতার পালা এখনই নয় আমার কাছে। কে জানে, গল্পের বাকি আছে হয়তো!

আপাতত মাশরাফির জন্য ভালোবাসা, দেশের ক্রিকেটের জন্য শুভ কামনা। নতুন দিনের যে গান বোর্ড-নির্বাচকরা-টিম ম্যানেজমেন্ট গাইছেন, সেই গান যেন সুরেলা হয়।

-ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link