ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে তাদের জুটি একটা সময় রাজত্ব করে গিয়েছে। এমন কোনও বোলিং লাইন আপ ছিল না, যারা শচীন টেন্ডুলকার এবং সৌরভ গাঙ্গুলির বিরুদ্ধে বল করতে চাপে থাকত না। দুইজনই অসম্ভব ভালো ব্যাটার ছিলেন তো বটেই, তাঁদের রসায়নটাও বেশ জমতো।
যখন জোড়া বেঁধে মাঠে নামবেন প্রচণ্ড শক্তিশালী জুটি গড়বেন – এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। কালক্রমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্যতম সেরা ওপেনিং জুটিতে পরিণত হলেন শচীন টেন্ডুলকার এবং সৌরভ গাঙ্গুলির জুটি। একসঙ্গে জুটি বেঁধে তাঁরা ভারতকে বহু ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। এই জুটি নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ চাইলে খরচ করা যায়।
এই এখন অবধি ভারতীয় ক্রিকেটে যতগুলো শক্তিশালী জুটি তৈরি হয়েছে, কোনটিই টেক্কা দিতে পারেনি শচীন আর সৌরভের জুটিকে। একদিকে মহারাষ্ট্রীয় শৌর্য্য, অন্যদিকে কলকাতার মিষ্টি বাঁশির সুর। দুয়ে মিলে যেন এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
টেন্ডুলকার ও গাঙ্গুলী ওয়ানডেতে সবচেয়ে সফল ওপেনিং জুটি হিসেবে ৬৬০০ রানের রেকর্ড গড়ে রেখেছেন। ২১ টি সেঞ্চুরি এবং ২৩ টি অর্ধশতক সহ টেন্ডুলকার এবং গাঙ্গুলীর জুটি অনায়াসে শীর্ষস্থান দখল করে আছে।
টেস্ট ঘরানায়ও তাঁরা দুজনে স্মরণীয় জুটি হয়ে আছেন। টেস্টে তাঁরা একসাথে ১২ টি সেঞ্চুরি প্লাস স্কোর সহ মোট ৪১৭৩ রানের জুটি গড়েছেন। তাঁদের সর্বোচ্চ জুটি ২৮১ রানের। তাঁরা ২৪৯ রানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পার্টনারশীপ গড়েছিলেন ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই বিখ্যাত লিডস টেস্টে ভারতীয় ক্রিকেটের তিন লিজেন্ড- দ্রাবিড়, টেন্ডুলকার এবং গাঙ্গুলি তিনজনই একই ম্যাচের একই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন।
দ্রাবিড়ের ১৪৮, টেন্ডুলকারের ১৯৩ এবং গাঙ্গুলির ১২৮ রানের উপর ভর করে ভারত ৬২৮/৮ এর বিশাল ইনিংস ঘোষণা করেছিল। সেই ম্যাচে বিশেষ করে টেন্ডুলকার-গাঙ্গুলীর পার্টনারশিপ ইংল্যান্ডের বোলিং লাইন আপকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ম্যাথিউ হগার্ড, অ্যালেক্স টিউডর, অ্যান্ড্রু ক্যাডিক- কেউই তাঁদের ব্যাটিং হতে রেহাই পাননি এবং প্রত্যেকেই ১০০ এর বেশি করে রান দিয়েছিলেন।
সনি লাইভে প্রচারিত ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘আর্কিটেক্টস ইন হোয়াইট’ এর সাক্ষাৎকারে ভারতীয় ব্যাটিং গ্রেট ও সাবেক অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কার বলেন, ‘সেই বিখ্যাত ভারতীয় ব্যাটিং জুটি টেন্ডুলকার এবং গাঙ্গুলি ইংল্যান্ডের বোলারদের এমনভাবে পেটাচ্ছিলেন, যা দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন আনাড়ি স্কুলপড়ুয়া। টেস্ট ম্যাচটি বেশ উপভোগ্য ছিল। শচীন ও সৌরভ এমনভাবে ব্যাটিং করেছিলেন যেন এটি টেস্ট নয় বরং একদিনের ম্যাচ। এতটাই সাবলীল ছিল তাঁদের ব্যাটিং।’
আসলে, মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে দু’জনের বোঝাপড়া ছিল দারুণ। তাই রসায়নটাও জমেছে বেশ। লিডসের সেই টেস্টে ভারত গোটা ম্যাচ জুড়েই দেখায় দাপট। ব্যাটিংয়ে এতটাই দাপট দেখায় তাঁরা নিজেদের প্রথম ইনিংসে যে দ্বিতীয়বার আর ব্যাটিংয়ে নামারই দরকার হয়নি। আট উইকেটে ৬২৮ রান সংগ্রহ করে সফরকারীরা।
জবাবে ইংল্যান্ড পরপর দু’বার ব্যাটিং করে প্রথমবার ২৭৩ ও দ্বিতীয় দফায় ৩০৯ রান করে। ফলে, তাঁদের হারতে হয় ইনিংস ও ৪৬ রানের বিরাট ব্যবধানে। ১৪৮ রানের ইনিংস খেলে সেই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন রাহুল দ্রাবিড়। যদিও, টেস্টটা মূলত টেন্ডুলকার ও গাঙ্গুলির অতিমানবীয় জুটির টেস্ট হিসেবেই খ্যাতি পেয়েছিল।
নি:সন্দেহে এটি বিশ্বমানের ব্যাটিংয়ের অসাধারণ প্রদর্শনী ছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে একসাথে ‘সোনালী অধ্যায়’ রচনা করেছিলেন এই ‘শচীন-সৌরভ’ জুটি। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গড়ে ওঠা নতুন কোন জুটি ভারতীয় ক্রিকেটকে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়- এইটুক প্রত্যাশা ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তরা লালন করতেই পারে।