খাটি সোনার খাঁদ

ইতিহাসের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচটায় ছিলেন তিনি। ছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের শুরুর দিন গুলোর হট কেক। ক্রিস্টোফর ল্যান্স কেয়ার্নস নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের তো বটেই, নিজের সময়েরই অন্যতম সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডারদের একজন ছিলেন তিনি।

অথচ ভাগ্যের কি নির্মমতা! ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ‍ওঠে তাঁর ওপর, ২০১৩ সালে। এতদিন সংগ্রাম করে পাওয়া অর্জন ও সম্মান মিশে যায় ধুলোতে। আর্থিক ভাবেও এতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন যে রীতিমত দিন মজুরের জীবন বেছে নিতে হয়। বাসের ছাউনি পরিস্কার করে সংসার চালাচ্ছেন – এমন খবর প্রকাশিত হয়েছিল নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডে।

একটু পেছনে ফিরে তাকালেই কেয়ার্নসের ভিন্ন এক জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়। ২২ গজে কি প্রতাপশালীই না ছিলেন। স্বয়ং শেন ওয়ার্ন যাকে বিশ্বের সেরা অল-রাউন্ডার হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ২০০০ সালে উইজডেন কর্তৃক নির্বাচিত ‘বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটার’-এর একজন ছিলেন তিনি।

দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডের মার্লবোরা অঞ্চলের পিকটনে ১৯৭০ সালের ১৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন কেয়ার্নস। নিজের রক্তেই হয়ত ক্রিকেটের রাজটিকা নিয়ে জন্মেছিলেন কেয়ার্নস। ক্রিসের বাবা ল্যান্স কেয়ার্নস ছিলেন নিউজিল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্রিকেটার। খেলেছিলেন ৪৩ টেস্ট ও ৭৮ টি ওয়ানডে।

কেয়ার্নস ছিলেন আক্রমণাত্মক এবং বুদ্ধিদীপ্ত খেলোয়াড়। খেলুড়ে জীবনের পরিসংখ্যানে ক্রিস টেস্ট ক্রিকেটে ৬২, ওয়ানডেতে ২১৫ এবং  প্রথম শ্রেণিতে ২১৭ টি ম্যাচ খেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পা ফেলার আগে ঘরোয়া লিগ নর্দার্ন ড্রিস্ট্রিক্টসের হয়ে যোগ দিয়ে ১৯৮৮-১৯৮৯ পর্যন্ত খেলেছিলেন তিনি।

১৯৮৯ সালের ২৪ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রণাঙ্গনে যাত্রা শুরু হলো তাঁর। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়ে জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১৯৯০ সালে তিনি ঘরোয়া দল  ক্যান্টারবারিতে যোগদান করেন এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই দলের হলেই ব্যাটে-বলে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে থাকেন।

১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সাল। কেয়ার্নসের ডাক পড়লো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য। ততদিনে টেস্ট খেলোয়াড় হিসেবে বছর চারেক কাটিয়ে ফেলেছেন।

সময় তখন ১৯৯৫। ভারতের পুনেতে নেহেরু স্টেডিয়ামে ওয়ানডে ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের  প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। সেই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল ঠিকই কিন্তু কেয়ার্নস তুলে নিলেন তার ইতিহাসের এক অনন্য ‘জয়’। ১০৩ রানের একটি দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাঁকালেন তিনি ওই ম্যাচে। তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি।

এরপর ১৯৯৯, ২০০০ এবং ২০০২ সালের আরও তিনটি ওয়ানডে সেঞ্চুরি তুলে নেন তিনি – এর মাঝে শেষের দু’টি সেঞ্চুরিতে ১০২* রানে তিনি ছিলেন অপরাজিত ব্যাটসম্যান। তাঁর তৃতীয় সেঞ্চুরিটি ছিল নিউজিল্যান্ডের জন্য গুরুত্ববহ।এর মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মতো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে যায়। তখন, ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময়ে ছিলেন কেয়ার্নস।

আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ বছর ২০০৪ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইডেন পার্কে খেলা ম্যাচটিতে তার রানসংখ্যা ছিল ১৫৮।  ওয়ানডের চেয়ে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর বোলিং রেকর্ড ছিল আরও চোখ ধাঁধানো।

১৯৯১ সালে ইডেন পার্কে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৭৫ রানের বিনিময়ে তুলে নেন পাঁচ উইকেট। এরপর ওই একই মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আরও নতুনভাবে যেনো জ্বলে উঠলেন। সেই ম্যাচে ৫২ রানের বিনিময়ে নিজের ঝুলিতে যোগ করেন আরও ছয় উইকেট।

ওয়ানডে ক্রিকেটে ১৯৯৮ সালে ম্যাকলিন পার্কে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪২ রান দিয়ে তুলে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। ১৯৯৯ সালে সিডন পার্কে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনি ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করেন। মাত্র ২৭ রানের বিনিময়ে নেন সাত উইকেট।

তার ক্যারিয়ারের অশনি সংকেত ছিল ইনজুরি। ইনজুরি প্রবণতার কারণে, কখনোই গ্রেট ক্রিকেটারদের কাতারে পৌঁছাতে পারেননি কেয়ার্নস। ১৫ বছরের লম্বা ক্যারিয়ারে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৬২ টি টেস্ট ও ১১৯ টি ওয়ানডে। সেখানে আট হাজারের ওপর রান ও ৩০০’র কাছাকাছি উইকেট পেয়েছেন।

২০১৪ সালের জুনে শেষ টেস্ট আর ২০০৬-এর জানুয়ারিতে শেষ ওয়ানডে খেলেন। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে নিষিদ্ধ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসেএল) জড়ান কেয়ার্নস। সব শেষে যোগ দিয়েছিলেন ধারাভাষ্যে। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের সাংবাদিক রিচার্ড বুক লিখেছিলেন, ‘ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা একজন অলরাউন্ডার হিসেবে স্মরণীয় হয়ে রইবেন কেয়ার্নস।’

স্মরণীয়-বরণীয় হয়েই ছিলেন তিনি। কিন্তু, নিন্দনীয় হলেন ২০০৯-১০ সালে। আইপিএল কমিশনার লোলিত মোদির এক টুইটে নতুন এক অন্ধকার অধ্যায়ের উন্মোচন হল ক্রিকেট বিশ্বের সামনে। এরপর থেকেই আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কেয়ার্নস। এর মধ্যে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সাথে বিবাদে জড়িয়েছেন, লু ভিনসেন্ট তো দোষ স্বীকার করে সাজা বরণ করে নিয়েছেন।

তবে, এখন অবধি কেয়ার্নসের বিরুদ্ধে ওঠা কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বরং দু’টি মামলায় তাঁর জয় হয়েছে। তবে, সব চুকেবুকে যায়নি এখনো। নিখাঁদ স্বর্ণের খাঁদ হয়ে জীবনের সাথে এখন এই আদালতের লড়াইটা জড়িয়ে আছে কেয়ার্নসের। এখানেই শেষ নয়, পারিবারিক জীবনে নেমে আসে অস্থিরতা। কর্মজীবন হয় বিপর্যস্ত। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি। বরং হার্ট অ্যাটাক করে কোমায় চলে যান, সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠলেও তিনি আদৌ আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link