কলিন্স ওবুয়া, কেনিয়ার বিশ্বকাপ হিরো

২০০৩ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসেছিল আফ্রিকার তিন দেশে। তাতে গোটা তিনেক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবার কথা কেনিয়াতেও। কিন্তু বেঁকে বসে নিউজিল্যান্ড, কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে নাইরোবি যেতে অস্বীকৃতি জানায় ব্ল্যাক ক্যাপরা। শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী ওয়াক ওভার পেয়ে যায় কেনিয়া, ফলে মাঠে না নেমেই চার পয়েন্ট পেয়ে যায় দলটি।

কেনিয়ার এই চার পয়েন্ট প্রাপ্তি গ্রুপ বি এর পুরো সমীকরণ পাল্টে দেয়। নতুন সমীকরণ অনুযায়ী আর মাত্র দুইটা জয় পেলেই সুপার সিক্সের টিকিট পেয়ে যাবে তারা। সেই আসরে বাংলাদেশের যা হতশ্রী ফর্ম চলছিল, তাতে তাদের বিপক্ষে কেনিয়ার জয়টাই প্রত্যাশিত, সাথে দরকার ছিল শ্রীলঙ্কা অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ – যেকোনো একটা বড় দলকে হারানো।

জয় পেতে কেনিয়া বেছে নেয় লংকানদের। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে লংকানদের ২১১ রানের লক্ষ্যমাত্রা দেয় তারা। মাপকাঠির বিচারে ২১১ রান লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে খুব একটা বড় ছিল না। কিন্তু সেদিন অতিমানবীয় হয়ে উঠেছিলেন এক লেগস্পিনার, যাকে কিনা তখনো পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছে বড় দুই ভাইয়ের ছায়ায়। ১৬ তম ওভারে বোলিং করতে এলেন।

‘এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন’ মতো করে টানা তিন ওভারে লেগ স্পিনের মায়াজালে বিভ্রান্ত করে সাজঘরে ফেরত পাঠালেন লংকান ব্যাটিংয়ের তিন স্তম্ভকে। কিন্তু তখনো উইকেটে টিকে ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা, টুকটুক করে লংকানদের এগিয়ে নিচ্ছিলেন জয়ের পথে। কিন্তু সেদিনটি ছিল কেবলই তার, গতির হেরফের করে বোকা বানালেন ডি সিলভাকেও। শেষপর্যন্ত ২৪ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে নিজের হাতে লিখলেন কেনিয়ার ক্রিকেট রূপকথা।

সদাহাস্য এই লেগ স্পিনারের নাম কলিন্স ওবুয়া।

নাইরোবিতে নিজেদের বাড়ির উঠানে বড় দুইভাইয়ের সাথে খেলতে খেলতেই কলিন্স ওবুয়ার ক্রিকেটার হয়ে উঠা। পরবর্তীতে তো তিনভাই একত্রেই খেলেছেন জাতীয় দলে। কিন্তু বড় দুই ভাই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হলেও কলিন্সের ঝোঁক ছিল বোলিংয়ে।

আব্দুল কাদির, শেন ওয়ার্ন, অনিল কুম্বলের মতো লেগস্পিনের শিল্পটা আয়ত্ত করার দিকে। বলকে হাওয়ায় ভাসিয়ে কিংবা গুগলিতে বিভ্রান্ত করে বড় দুই ভাইকে বোকা বানাতেই তার যত আনন্দ। ব্যাটিংয়ের হাতটাও নেহাত মন্দ না, কিন্তু হৃদয়ের সমস্তটা যেন উজাড় করে দিয়েছেন লেগস্পিনে।

২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ওবুয়ার। পরের দুই বছর দলে আসা-যাওয়ার মাঝে থাকলেও জায়গা করে নেন ২০০৩ বিশ্বকাপগামী দলে। ‘মহাতারকারা বোধহয় নিজেদের চেনানোর জন্য বেছে নেন বড় মঞ্চকেই’ ওবুয়াও বোধহয় সেটাই ভেবেছিলেন। তার জন্য বিশ্বকাপের চেয়ে বড় মঞ্চ আর কিছুই হতে পারতো না। সেবার দারুণ বল করে দলকে নিয়ে যান সেমিফাইনালে।

কেনিয়ার সেমিফাইনাল খেলা ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা অঘটন। সেবার আসিফ করিমকে সাথে নিয়ে দলের স্পিন ডিপার্টমেন্ট সামলেছেন তিনিই। পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে ব্যাট হাতেও খেলেছেন ছোট কিন্তু কার্যকরী সব ইনিংস।

কিন্তু সেবারের বিশ্বকাপের পরই ধীরে ধীরে অস্তমিত হতে থাকে কেনিয়ার ক্রিকেট সূর্য। ক্রিকেট মানচিত্র থেকে হারিয়েই যায় আফ্রিকার এই দেশটি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ওবুয়া চুক্তিবদ্ধ হন কাউন্টি দল ওয়ারউইকশায়ারের সাথে। তাদের হয়ে খেলেন প্রায় ৫০ এর অধিক ম্যাচ। এরপর চুটিয়ে খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রাদেশিক টুর্নামেন্টগুলোতে। কিন্তু দেশের ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি টোয়েন্টি অভিষেক ঘটে তার।

২০১১ সালে কেনিয়ার হয়ে আবারো বিশ্ব আসরে অংশ নেন ওবুয়া। ততদিনে ম্যাচ প্রাকটিসের অভাবে ওবুয়া ভুলতে বসেছেন লেগস্পিন, বনে গেছেন পুরোদস্তুর স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান। ব্যাট হাতে দেখিয়ে দেন তখনো ফুরিয়ে যাননি তিনি, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার ৯৮ রানের ইনিংস এখনো উজ্জ্বল ক্রিকেটভক্তদের মনে। কেনিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ইনিংসটি ওবুয়ারও ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ। বিশ্বকাপের পর আবারো একপ্রকার ক্রিকেটীয় দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান ওবুয়া।

ওবুয়া পুনরায় জাতীয় দলে ফিরে আসেন ২০১৮ সালে। সেবারের আফ্রিকা টি টোয়েন্টি কাপে কেনিয়ার অধিনায়কত্ব করেন তিনি। ছিলেন পরের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের জন্য ঘোষিত দলেও, কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে দল থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন তিনি।

ফলে ২০১৯ সালে পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে ম্যাচটাই হয়ে আছে এখনো পর্যন্ত ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হিসেবে। জাতীয় দলে হয়ে ১০৪ ওয়ানডেতে ১১ ফিফটিতে তার সংগ্রহ ২,০৪৪ রান। পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেছেন ৩৫ উইকেট। ৩৫টি টোয়েন্টি খেলে তার সংগ্রহ ৬৯১ রান এবং ২৩ উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে এখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় জানাননি। কে জানে, ৪০-এর ওপর বয়স নিয়ে হয়তো আবারো খেলবেন আন্তর্জাতিক ময়দানে।

পরিসংখ্যান আপনাকে কখনোই বুঝাতে পারবে না কলিন্স ওবুয়া কতটা কার্যকর ক্রিকেটার ছিলেন। মৃতপ্রায় কেনিয়ার ক্রিকেটকে একা হাতে সামনে টেনেছেন বহুদিন। নেভিল কার্ডাস তো এমনি এমনি বলেননি, ‘পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link