ফাইনালের নায়ক কিংবা আড়ালের নায়ক

অসীম প্রতিভাধর কেউ নন, তবু বাইশ গজই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ক্রিকেটের টানে দেশ ছেড়েছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখতেই বয়স পেরিয়ে গেছে ত্রিশের কোটা। তবে ক্রিকেট ঈশ্বর বোধহয় এতটাও নিষ্ঠুর নন। সেই কারণেই কিনা কিউই মূলুক ছাপিয়ে আইপিএলের মঞ্চেও শিরোপা জয়ের নায়ক ডেভন কনওয়ে।

ছোটবেলায় ফুটবলের প্রেমে পড়লেও কৈশোরে পা দিতেই বদলে যায় প্রথম প্রেম। ফুটবল ছেড়ে কনওয়ে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন ক্রিকেটেই। কিন্তু পাড়ার ক্রিকেট আর পেশাদার ক্রিকেটের পার্থ্যকটা টের পেতে সময় লাগেনি। কনওয়ে বুঝে যান বড়ই কন্টকাকীর্ণ এই পথ।

বয়সভিত্তিক দলের সতীর্থরা যখন জাতীয় দলের হয়ে মাঠ মাতাচ্ছেন, কনওয়ে তখনো দ্বিতীয় বিভাগের গন্ডি পেরোতে পারেননি। রানের পর রান করে গেছেন, কিন্তু তাঁকে সুযোগ দেবার আগ্রহ জন্মায়নি কোনো দলেরই।

ফলে একদিন কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে যাত্রা করেন নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। এরপরই যেন ভাগ্যের চাকা উল্টোপথে ঘুরতে শুরু করে এই তারকার। ঘরোয়া ক্রিকেট পেরিয়ে নিউজিল্যান্ড জাতীয় দল- সবখানেই রান করেছেন দেদারসে। লর্ডসে টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছেন, সাদা বলের ক্রিকেটেও ভীষণ ধারাবাহিক।

উইকেটের চারপাশে শট খেলতে জানেন, ব্যাটিং টেকনিকে গলদ নেই মোটেই। পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি স্পিন সামলাতেও দারুণ পটু এই ওপেনার। দলের প্রয়োজনে যেমন একপ্রান্ত আগলে খেলতে জানেন, তেমনি সময়ের দাবিতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এমন একজন ব্যাটার বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে সফল হবেন এমনটাই তো স্বাভাবিক।

আইপিএলে গত মৌসুমে চেন্নাই তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিল বেঞ্চ শক্তিশালী করতেই। মঈন আলীর অনুপস্থিতিতে মাঝে তিন ম্যাচে সুযোগ পেলেও আলাদা করে নজর কাড়তে পারেননি। ফলে তারকাবহুল চেন্নাই টপ অর্ডারে কনওয়ের ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে।

তবে কনওয়ে জানতেন সুযোগ মিলবে, কেবল সেটা কাজে লাগানোর অপেক্ষা। মৌসুমের শেষবেলায় এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ, টানা তিন ফিফটিতে কনওয়ে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর উপর আস্থা রাখা যায়। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

এবারের মৌসুমের শুরু থেকেই ছিলেন দারুণ ছন্দে। রুতুরাজ গায়কোয়াড়কে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন দারুণ এক উদ্বোধনী জুটি। প্রায় প্রতি ম্যাচেই দারুণ শুরুতে কাজটা সহজ করে দিয়েছেন মিডল অর্ডারের জন্য। এবারের মৌসুমে ১৬ ম্যাচে ৫১ গড় এবং ১৩৯ স্ট্রাইকরেটে তাঁর সংগ্রহ ৬৭২ রান।

তবে গোটা টুর্নামেন্টে রান করা আর ফাইনালে চাপের মুখে পারফর্ম করা এক কথা নয়। বরং ফাইনালের চাপে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ার ইতিহাস পুরনো নয়। তবে কনওয়ে যেন অন্য ধাতুতে গড়া, ১৫ ওভারে ১৭১ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে তিনি যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ইনিংসের শুরু থেকেই তাই দেখা মিললো ভিন্ন কনওয়ের। ভেজা পিচে শামি-লিটলদের বিষাক্ত সব ডেলিভারি সামলে রানের গতি বাড়িয়ে নিয়েছেন প্রতিনিয়ত। যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন কখনোই মনে হয়নি বোলাররা সামান্যতম বিপদে ফেলতে পেরেছে তাঁকে।

তাঁর ২৫ বলে ৪৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংসেই জয়ের ভিত্তিটা পেয়েছে চেন্নাই। চারটি চার এবং দুই ছক্কায় সাজানো এই ইনিংসেই মূলত পথ হারিয়েছে গুজরাটের পেসাররা, ফলে ফাইনাল সেরার পুরষ্কারটা উঠেছে কনওয়ের গলাতেই।

জোহানেসবার্গ থেকে আহমেদাবাদ, অসীম প্রতিভাবান সব মহামানবের ভীড়ে কনওয়েরা যেন সাধারণ মানুষের জীবনের জয়গান গেয়ে যান অনুপ্রেরণা হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link