কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি তাঁর খোঁজ পান…

তবু উলমারের মৃত্যুদিন তো আর অজানা নয়। ১৯৮৫ সালে অক্টোবর মাসের এক সকালে তিনি নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর আর কখনও ফিরে আসেননি। তখন তাঁর বয়েস ৮৯। এরপর পুলিশ, বাড়ির লোক গরু খোঁজা করে খুঁজেও আর তাঁর সন্ধান পায়নি। পরে উইজডেন তাঁকে ডেড, আননোন হিসেবে ঘোষণা করে।

তাঁকে কি বলে ডাকা যায়? ‘ক্রিকেটের সুভাষ’? না গুপ্তের কথা বলছি না। আমি বলছি কোটা (মতান্তরে কোটার) রামস্বামীর কথা। কেন এমন বললাম? কারণ তাঁর মৃত্যুও তো নেতাজি সুভাষের মৃত্যুর মতোই রহস্যের ঘন আস্তরণে আচ্ছন্ন।

বহু ক্রিকেটার আত্মহত্যা করেছেন। বহু ক্রিকেটার যুদ্ধে মারা গেছেন। কেউ দুর্ঘটনায়। কিন্তু তাঁর মতো রহস্য, তাও এতদিন ধরে কারও’র মৃত্যু ঘিরে নেই। মানে, তিনি আদৌ কবে মারা গেছেন, মারা গেছেন কি না ইত্যাদি প্রশ্ন গুলোর কোনো সদুত্তর আজ এতো বছর বাদেও নেই। ক্রিকেটে খুব কাছাকাছি উদাহরণ হবেন বব উলমার।

তবু উলমারের মৃত্যুদিন তো আর অজানা নয়। ১৯৮৫ সালে অক্টোবর মাসের এক সকালে তিনি নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর আর কখনও ফিরে আসেননি। তখন তাঁর বয়েস ৮৯। এরপর পুলিশ, বাড়ির লোক গরু খোঁজা করে খুঁজেও আর তাঁর সন্ধান পায়নি। পরে উইজডেন তাঁকে ডেড, আননোন হিসেবে ঘোষণা করে।

অনেকের মতে, বাড়ির লোকের প্রতি বোঝা যাতে না হয়ে যান, তাই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ব্যাখ্যাটা আজকের ৫০ হাজার কোটি ও সাততারা হোটেলের ভারতীয় ক্রিকেটে মিনমিনে হতে পারে, সেকালেও যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য ছিল। ভারতের প্রথম টেস্ট উইকেট রক্ষক জনার্দন নাবলেকে নাকি শেষ জীবনে চরম দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। আর্থিক নিশ্চয়তা একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটারদের কাছে আকাশের চাঁদ ছিল।

আর ক্রিকেটাররা ছিলেন বামন। তবে এই যুক্তিটা কি রামস্বামীর ক্ষেত্রে খাটে? সেটাই একটু খতিয়ে দেখতে ইচ্ছা করলো।

দক্ষিণ ভারতের ক্রিকেটের জনক বুচি বাবু নাইডুর ছেলে ছিলেন রামস্বামী। যদিও দিদার বাড়িতে বেড়ে ওঠা তিনি, মায়ের পদবীটিই ব্যবহার করতেন। ১৯১৫-১৬ সালে ইওরোপিয়ান দলের বিরুদ্ধে রামস্বামী অভিষেক করেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। তাঁর সংগ্রহ ছিল ২১, ৩১ ও ২৪ রানে ২ উইকেট।

তখন মাদ্রাজে ফি-বছর ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের এই ম্যাচটি হতো মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ম্যাচ নাম দিয়ে। পরের বছর এই ম্যাচেই করলেন ৯২ ও ৪৪। সাথে ৬ উইকেট। মাদ্রাজের ক্রিকেট সার্কিটে তাঁর নাম হয়ে গেলো। অবশ্য ১৯১৯ এ কেমব্রিজে পড়তে চলে যাওয়া তিনি পরের ৪ বছর ক্রিকেট থেকে অনেক দূরের গ্রহ টেনিসে পদার্পন করেন। ডেভিস কাপও খেলা হয়ে যায় তাঁর। উইম্বল্ডনও খেলে ফেলেন ১৯২২ সালে।

১৯২৩ এ কেমব্রিজের পড়া শেষ করে দেশে ফেরেন তিনি। এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের অফিসার এর চাকরিও পান। সাথে চালিয়ে যান ক্রিকেট। রঞ্জি ট্রফিতে নিয়মিত পারফর্ম করতে থাকেন। তবে ১৯৩২ এ ভারতের টেস্ট অভিষেকের পরেও তাঁর টেস্ট খেলা হয়নি। এরপর ১৯৩৬ এর কুখ্যাত ইংল্যান্ড সফরে দলে তাঁর নাম দেখতে পেয়ে তিনি নিজেই খানিক হতবাক হয়ে যান।

ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজার নেতৃত্বে সেই ইংল্যান্ড সফর ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম কালিমালিপ্ত সফর। রামস্বামী নিজেও লিখেছিলেন, তাঁর নির্বাচন তাঁর নিজের কাছেই বোধগম্য না। কারণ তিনি ততোদিনে প্রায় ৪০। একটু মোটাও হয়েছেন বোধহয়। তবে জ্যাক রাইডারের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর প্রদর্শন অন্য সাক্ষ্যই বহন করে।

মাদ্রাজের প্রথম ইনিংসের ১৪৭ এর মধ্যে রামস্বামীর একারই অপরাজিত ৪৮। অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ইনিংসে ৪৭ রানে অল-আউট করতে বড়ো ভূমিকা নেন রামস্বামীরই ‘ডাবল আন্তর্জাতিক’ দোসর এম.যে গোপালন। দ্বিতীয় ইনিংসে রামস্বামীর সংগ্রহ ৮২। এবার ১৬৫র মধ্যে। কাজেই একেবারে নির্মোহ ভাবে দেখলেও, রামস্বামীর ইংল্যান্ডের জাহাজে ওঠা নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকা উচিত নয়।

সেই সফরে তিনটির মধ্যে দুটি টেস্টে রামস্বামী সুযোগ পান। ৪০ এর ওপরে ভারতের দ্বিতীয় সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার হিসাবে তাঁর টেস্ট অভিষেক ঘটে। শেষ করেন ৫৬.৬৬ গড়ে ১৭০ রান করে। একটি পঞ্চাশ সহ। এরপর আর টেস্ট খেলা হয়নি তাঁর। বাকি সফরেও তাঁর ভালো ফর্ম ছিল অব্যাহত।

৭৩৭ রান করেন ৩০.৭৭ গড়ে। যদি কোনো ইনিংস বা রানের বেড়াজালে না ফেলে দেখা হয়, তবে রামস্বামী হলেন গড়ের বিচারে ভারতীয়দের মধ্যে চতুর্থ। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন আরও বছর পাঁচেক। লম্বা বাঁহাতি ব্যাট, রামস্বামীর হাতে ছিল বেশ ভালো কিছু স্ট্রোক। খেলা ছাড়ার পরেও কয়েক বছর নির্বাচক ছিলেন। ১৯৫২/৫৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারতের ম্যানেজার হয়ে যান।

যথেষ্ট বিত্তশালী পরিবারে বড়ো হয়েছিলেন রামস্বামী। নিজেরও ছিল যথেষ্ট আয়। আর্থিক দৃষ্টিকোণটা তাঁর ক্ষেত্রে ততটা জোরালো কি? তাহলে শারীরিক ভাবে ভেঙে যাওয়া? বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে প্রতাপ রামচাঁদ কিন্তু অন্য সাক্ষ্য দিচ্ছেন। তাঁর অন্তর্ধানের মাস বারো আগে তিনি নিজে রামস্বামীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সাক্ষ্যাৎকার নেন। হিয়ারিং এড ও হালকা স্মৃতিভ্রম বাদে বাকি পুরোটাই বয়সের তুলনায় অনেক চনমনে রামস্বামী।

তাহলে কি? কেউ জানে না। ভারতীয় রাজনীতিতে যেমন নেতাজি, ভারতীয় ক্রিকেট বা টেনিসে ততটা হয়তো নন রামস্বামী। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে মাত্র দুজন টেস্ট ক্রিকেটার ডাবল ইন্টারন্যাশনালের মধ্যে তিনি একজন।

তবুও তাঁর এই আকস্মিক রহস্যময় অন্তর্ধান ঘিরে কোনো আলোচনা হয় না। বোধহয় ভারতীয় ক্রিকেটের জাঁকজমক আমাদের আলোচনা করার সময় দেয় না। তাই তাঁকে নিয়ে লেখাটা রেখে গেলাম। যদি কোনো সহৃদয় ব্যক্তি তাঁকে নিয়ে একটু ভাবার অবকাশ পান !

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...