ব্যাপারটা নিয়ে খুব রসিকতা হচ্ছে। ছেলেটাকে সবাই হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলেছে।
স্পিনার নাসুম আহমেদ দেশে নেমে বলেছেন, নিউজিল্যান্ডে আকাশ পরিস্কার ছিল; তাই ক্যাচ ধরতে সমস্যা হয়েছে। এটা কী খুব হাস্যকর কথা?
আপাত দৃষ্টিতে হাসির ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে।
পরিস্কার আকাশের সাথে ক্যাচ ধরতে পারার সম্পর্কটা কী? আমাদের সাধারণ বুদ্ধি বলে, আকাশ পরিষ্কার থাকলে বল তো আরও ভালো দেখতে পাওয়ার কথা। তখন তো ক্যাচিং আরও ভালো হবে। তাহলে নাসুম এই ‘অদ্ভুত’ কথাটা কেন বললেন?
নাসুমের কথাটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে, কারণ তিনি পরিস্কার করে বলতে পারেননি। তিনি কেবল বটম লাইনটা বলেই শেষ করে দিয়েছেন। বলেছেন, কন্ডিশনের কারণে ক্যাচ ধরতে সমস্যা হয়। আর এটাই খবর হয়ে গেছে, শিরোনাম হয়েছে; লোকেরা এটা পরে তাকে হাসির পাত্র বানাচ্ছে।
অথচ ব্যাপারটা এর বিপরীত।
নিউজিল্যান্ডে খেলার অভিজ্ঞতা আছে এমন কয়েক জন ক্রিকেটারের সাথে কথা বলেছিলাম। তারা বলেছেন, নাসুম দারুন একটা পয়েন্ট তুলে এনেছেন। আসলেই নিউজিল্যান্ডের আকাশ বেশি পরিস্কার থাকায় উচুতে ওঠা বল ধরতে সমস্যা হয়। কন্ডিশনের কারণেও (আসলে বাতাসের কারণে) বল ধরতে সমস্যা হয়।
একটু বৈজ্ঞানিক কারণটা জেনে নেওয়া যাক।
উপমহাদেশে বা বেশিরভাগ জায়গায় আকাশের মেঘ বলের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করে। বল যখন উপরে উঠে যায় ওই ভিন্ন রংয়ের কারণে বলটা চোখে দেখা যায়। কিন্তু আকাশ অস্বাভাবিক পরিষ্কার হলে ব্যাকগ্রাউন্ড বলে কিছু থাকে না। ফলে ওপরে ওঠার পর ফ্রাকশন অব সেকেন্ডের জন্য বল চোখ থেকে হারিয়ে যায়। আর এটাই বলকে মিস করার জন্য যথেষ্ঠ। নিউজিল্যান্ডে খেলা বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটার বিভিন্ন সময় এই অভিযোগ করেছেন।
এবার আসেন নাসুম যেটাকে কন্ডিশনের সমস্যা বলেছেন, সেই বাতাসের ব্যাপারে।
নিউজিল্যান্ডে বল বাতাসে ভাসলেই তার ফ্লাইট অনুমান করা দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার হয়ে পড়ে। অস্বাভাবিক বাতাস বলের গতি-পথ বদলে ফেলে।
এখন কথা হচ্ছে, এসবের সাথে নাসুমরা এই সময়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারতেন। কিংবা মুশফিক, রিয়াদ বা মেহেদী যে ধরণের ক্যাচ ফেলেছেন তাতে আকাশ বা বাতাসের খুব এটা ভূমিকা ছিলো না। এসব আলোচনা একপাশে রেখেও বলা যায়, নাসুম খুব ভুল কিছু বলেননি। তারপরও নাসুমকে নিয়ে হাসিঠাট্টা হচ্ছে কেনো?
কারণ, নাসুম বুঝিয়ে বলতে পারেননি।
আর আমি এতোক্ষণে আসলে এই ‘বুঝিয়ে বলতে পারা’ ব্যাপারটাতে আসতে চাচ্ছিলাম।
আমাদের খেলোয়াড়দের এটা একটা বড় সমস্যা। তারা সঠিকটা ভেবেও ভুলটা বলে ফেলেন। মানে, প্রায়শ বুঝিয়ে বলতে পারেন না। যার ফলে উল্টো পাল্টা অর্থ তৈরী হয় কথার। কখনো সে জন্য তারা হাসির কারণ হন, কখনো ক্ষোভের কারণ হন। পরে দায়টা পড়ে গিয়ে মিডিয়ার ওপর। খেলোয়াড়রা ভাবেন, মিডিয়া তাদের ‘ভিলেন’ বানাচ্ছে।
অথচ ভিলেন বানাচ্ছে আসলে সিস্টেম।
দুনিয়ার সব বড় ফেডারেশনেরই নিজের স্ট্যাফদের, বিশেষত খেলোয়াড়দের মিডিয়া হ্যান্ডেলিং বিষয়ে ট্রেনিং করানোর একটা ব্যাপার থাকে। বাংলাদেশেও এটা রপ্ত করিয়েছিলেন এক সময়ের হাই পারফরম্যান্স কোচ রিচার্ড ম্যাকিন্স। তার সময়ে এই ট্রেনিং পাওয়া সাকিব আল হাসান, শাহরিয়ার নাফীস, মুশফিকুর রহিমরা দেখবেন তাই মিডিয়াতে কখনো কথা বলতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন না। কারণ, এরা প্রোপার ট্রেনিংয়ের ভেতর দিয়ে এসেছেন।
এরপর বিসিবি একবার উদ্যোগ নিয়েছিলো তরুন খেলোয়াড়দের ট্রেনিং করানোর। সে উদ্যোগ দীর্ঘ হয়নি। সর্বশেষ বাংলাদেশের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলটাকে নিয়েও প্রেস হ্যান্ডেলিং বিষয়ে অনেক কাজ করা হয়েছিলো বলে শুনেছি। প্রান্তিক নওরোজ নাবিলের মত দু এক জন তো খ্যাতি পেয়ে গেছেন কথা বলার জন্য। মাহমুদুল হাসান জয়, শামীম পাটোয়ারি বা তৌহিদ হৃদয়ও বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের টিম ম্যানেজমেন্টকে বুঝতে হবে, সবাই বয়সভিত্তিক দলের কাঠামো থেকে আসেন না জাতীয় দলে। ফলে সবার প্রপার ট্রেনিং থাকে না এই সংবাদ মাধ্যম সামলানোর। ফলে কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যায়। অযথা হাসি বা ক্ষোভ তৈরী হয়।
সে জন্যই আসল দোষীকে চিনতে না পেরে মুমিনুল হকরা বলে ফেলেন, ‘খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য মিডিয়াও দায়ী।’
আসলে দায়ী তাদের মিডিয়াটা সুন্দরভাবে সামলাতে না পারা।
দেখুন, আজকের দিনে খেলাটা স্রেফ খেলা নেই। এটা একটা পারফর্মিং আর্ট। এখানে আপনি আসলে হলিউড বা ঢাকার ফিল্মের একজন অভিনেতার মতই জীবন যাপন করেন। স্রেফ ভালো অভিনয় দিয়ে সেলিব্রিটি ইমেজ ধরে রাখা যায় না। স্রেফ ভালো খেলে ইমেজ ধরে রাখতে পারবেন না। আপনাকে আরও অনেক কিছু পারতে হবে।
নিজের একটা আলাদা শো অফের জীবন তৈরী করতে হবে। সেখানে আপনাকে মিডিয়া, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম সামলানোও শিখতে হবে। লাইভে এসে মজা করতে পারতে হবে। আর এগুলো সব মিলিয়েই এখন খেলা।
খেলা এখন একটা প্যাকেজ।
চ্যাম্পিয়ন হতে চাইলে পুরো প্যাকেজেই দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। জাস্ট লাইক সাকিব আল হাসান।