নিষ্ঠুর-নিখুঁত-নির্মম

একটা মানুষ কীভাবে এত নিখুঁত ইয়র্কার দিতে পারে, তাও ক্লান্তিহীনভাবে একটার পর একটা, সেটা মালিঙ্গাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। গ্লেন ম্যাকগ্রা যদি বোলিং-মেশিন হন, তো মালিঙ্গা হচ্ছে ইয়র্কার-মেশিন! ইয়র্কার দেবার এমন সহজাত ক্ষমতা সত্যি বলতে আর কারও মধ্যে দেখি নি আমি।

একটা মানুষ কীভাবে এত নিখুঁত ইয়র্কার দিতে পারে, তাও ক্লান্তিহীনভাবে একটার পর একটা, সেটা মালিঙ্গাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। গ্লেন ম্যাকগ্রা যদি বোলিং-মেশিন হন, তো মালিঙ্গা হচ্ছে ইয়র্কার-মেশিন! ইয়র্কার দেবার এমন সহজাত ক্ষমতা সত্যি বলতে আর কারও মধ্যে দেখি নি আমি।

পুরনো বলে তো অনেকেই ইয়র্কার দেয়, কিন্তু নতুন বলে? ঠিক এই জায়গাতেই মালিঙ্গা অন্যদের থেকে আলাদা। এমনকি বয়স, ফিটনেসও বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তাঁর সামনে। এই তো ক’দিন আগে বিশ্বকাপে, বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখিয়ে ম্যাচ জেতালেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ৪টা উইকেটের ভেতর ৩টাই ছিল ইয়র্কারে!
মালিঙ্গাকে প্রথম দেখি সাদা পোশাকের ক্রিকেটে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডেব্যু টেস্ট খেলতে নেমেছিল, ভেন্যু ছিল ডারউইন। সেই ডারউইন! যেখানে বাংলাদেশও টেস্ট খেলেছে।

তো প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে যায় ঝাঁকড়া চুলের এই তরুণকে, মূলত গতি আর ব্যতিক্রমী অ্যাকশনের কারণে। অমন রাউন্ড আর্মিশ, কিম্ভুতকিমাকার অ্যাকশন তো আর সচরাচর দেখা যায় না। মালিঙ্গার নামটাও এমন যে একবার শুনেই মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল!

টেস্টে মালিঙ্গার প্রথম শিকার ছিল ড্যারেন লেম্যান। ইয়র্কার দিয়েছিল, সামলাতে পারে নি, প্লাম্ব ইনফ্রন্ট! প্রথম ইনিংসে খুব বেশি উইকেট না পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ বোলিং করেছিল, লেম্যানকেই আবার আউট করেছিল গোটা চারেক উইকেটসহ।

পরের টেস্টের ভেন্যু ছিল কেয়ার্নস। হ্যাঁ, এই ভেন্যুর সাথেও আগে থেকে পরিচয় ছিল বাংলাদেশের খেলার সুবাদেই। তো কেয়ার্নস টেস্টে বোধ হয় মালিঙ্গাসহ পুরো লঙ্কান বোলিং ইউনিটই বেধড়ক পিটুনি খেয়েছিল। মালিঙ্গাকে সবচেয়ে বেশি পিটিয়েছিল হেইডেন আর লেম্যান। শুরুতে মার খেলেও মালিঙ্গা কিন্তু ফিরে এসেছিল পরে, ৪ উইকেট নিয়েছিল আবারও।

তো এই গেল অভিষেক টেস্টের কথা। বাংলাদেশের মালিঙ্গা দর্শনের অভিজ্ঞতাও একটু বলি। ২০০৫ সালের কথা। কলম্বোয় সিরিজের প্রথম টেস্ট। দিনের খেলা শুরু হতে না হতেই মালিঙ্গার ইয়র্কারে ছত্রখান শাহরিয়ার নাফীসের স্ট্যাম্প! অবশ্য পরে আমাদের তৎকালীন অধিনায়ক বাশার ভাইয়ের হাতে মারও খেয়েছিলেন খানিক; মুরালি-হেরাথদের দাপটে আর কোন উইকেটও মেলে নি। দ্বিতীয় ইনিংসের কথা তেমন মনে নেই। তবে একাধিক উইকেট পেয়েছিলেন এটা নিশ্চিত। বাংলাদেশ হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে।

একটু বলে রাখি, মালিঙ্গার টেস্ট ক্যারিয়ারটা ঠিক সেভাবে পূর্ণতা পায় নি। কারণ একটাই — ইনজুরি। মাত্র ৩০টা টেস্ট খেলেছেন, উইকেট পেয়েছেন ১০১টা। সর্বশেষ খেলেছেন ২০১০ সালে, ভারতের বিপক্ষে মুরালিধরনের বিদায়ী ম্যাচে। এর কিছুদিন আগেই অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিলেন হাঁটুর ইনজুরির কারণে আর কোনদিন টেস্ট খেলবেন না। কিন্তু মুরালিকে সম্মান জানাতেই ফিরে এসেছিলেন শেষবারের জন্য। তো ‘মুরালি’র টেস্টে ৮ উইকেট নিয়ে মালিঙ্গাই হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা! ৮০০ উইকেটের মাইল ফলক ছুঁয়ে মুরালির বিদায়টাও হয়েছিল রাজার মতোই।

তো এবারে ওয়ানডের মালিঙ্গাকে নিয়ে কিছু বলা যাক। অস্ট্রেলিয়ার সাথে টেস্ট ডেব্যুর ক’দিন পরই ছিল এশিয়া কাপ। মালিঙ্গার ওয়ানডে ডেব্যুটা হয়েছিল সেখানেই, প্রতিপক্ষ ছিল ইউএই। ওই ম্যাচের স্মৃতি তেমন মনে নেই। তবে মনে আছে পরের ম্যাচটার কথা, প্রতিপক্ষ যে ছিল বাংলাদেশ! আমরা বোধ হয় ১০ উইকেটে হেরেছিলাম ম্যাচটা। মালিঙ্গা তখন চমৎকার আউটসুইং করাত (এখনও করায়)। রাজিন সালেহকে কট বিহাইন্ড করেছিল সে রকমই দুর্দান্ত এক আউটসুইঙ্গারে।

এরপরের ঘটনাটা ২০০৭ বিশ্বকাপের। সুপার এইটে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক সেই ম্যাচ। এখনও মনে আছে, পাঁচ উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ৬ ওভারে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল মাত্র ১০ রান। ঠিক এমন সময় মালিঙ্গা দেখালেন ম্যাজিক! ম্যাজিকই তো! ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে টানা চার বলে তুলে নিলেন চার উইকেট! ক্রিকেটীয় পরিভাষায় এটাকে বলে ‘ফোর ইন ফোর’ বা ‘ডাবল হ্যাটট্রিক’। যার কৃতিত্ব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর কারও নেই! কিন্তু আফসোস যে এত কিছু করেও ম্যাচটা জেতাতে পারেন নি তিনি, হারতে হয়েছিল ১ উইকেটে।

এবার বলব ‘ব্যাটসম্যান’ মালিঙ্গার এক অবিশ্বাস্য কীর্তির কথা। ২০১০ সালের ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মেলবোর্নে ১ উইকেটের এক অবিস্মরণীয় জয় পেয়েছিল লঙ্কানরা। সরাসরি উপভোগ করেছিলাম ম্যাচটা। টার্গেট ছিল ২৪০ রান। শ্রীলঙ্কার ৮ নম্বর উইকেটটা পড়েছিল ১০৭ রানে। খেলা তো ওখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু না, মালিঙ্গা যে আবারও ম্যাজিক দেখাবেন বলে পণ করেছিলেন! বল হাতে নয়; ব্যাট হাতে!

নবম উইকেট জুটিতে ম্যাথুস আর মালিঙ্গা মিলে গড়লেন ১৩২ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ। জ্যাভিয়ের ডোহার্টিকে দুই ছক্কা মারা মালিঙ্গা পেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি (৫৬)। আর ম্যাচ সেরা ম্যাথুস অপরাজিত ছিলেন ৭৭ রানে। মালিঙ্গার ক্যারিয়ারে আর কোন ফিফটি নেই। তাই এই ইনিংসটা মালিঙ্গার কাছে নিঃসন্দেহে ভেরি ভেরি স্পেশাল; আমার কাছেও এটি যেকোন টেইলএন্ডারের খেলা সেরা ওয়ানডে ইনিংস।

মালিঙ্গা একা হাতে অসংখ্য ম্যাচ যেমন জিতিয়েছেন, তেমনি কখনো কখনো ব্যর্থও হয়েছেন। বেদম মারও খেতে হয়েছে অনেকবার। সেরকমই একটা স্মৃতি মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। ২০১২ সালের ঘটনা। হোবার্টের বেলেরিভ ওভালে বিরাট কোহলি নামের এক জিনিয়াসের হাতে কী মারটাই না খেয়েছিলেন মালিঙ্গা! কোথায় বল ফেলবেন বুঝতেই পারছিলেন না। ৮ ওভারে দিয়েছিলেন ৯৬ রান! ওভার প্রতি ১২ রান! শ্রীলঙ্কার দেয়া ৩২০ রানের টার্গেট কোহলি ম্যাজিকে ভর করে মাত্র ৩৬ ওভারেই পেড়িয়ে গিয়েছিল ভারত। এই ম্যাচটার কথা পারলে স্মৃতি থেকে নিশ্চয়ই মুছে ফেলতে চাইবেন মালিঙ্গা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link