মেহেদী হাসান মিরাজ পেছন ফিরে তাকিয়ে একটু নিজের পরিচয় নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেতে পারেন। ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অধিনায়ক, টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় এবং ওই পর্যায়ের দারুণ এক অলরাউন্ডার।
সেই মিরাজের এখন পরিচয়টা কী? তিনি কী একজন অলরাউন্ডার? না। তিনি কী কার্যকর বোলার? তাও তো না!
পরিসংখ্যানে একটু চোখ বুলিয়ে নিই। ওয়ানডেতে ৪১ ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে করেছেন ৩৯৩ রান; ব্যাটিং গড় ১৭.৮৬। অনেকেই বলে থাকেন মেহেদী মিরাজ এখন দলে খেলেন বোলার হিসেবে। তা অফ স্পিনার হিসেবে খেলা মিরাজের বোলিং গড় কত জানেন? ৪০.৬২! ৪১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তিনি উইকেট পেয়েছেন মাত্র ৪০ টি!
মেহেদী মিরাজের পেছন ফিরে তাকানোর কথা বলছিলাম শুরুতেই। মিরাজ যেহেতু আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন না, আমরাই একটু পেছন ফিরে তাকাই। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে ওয়ানডেতে ৫৬ ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে করেছেন ১৩০৫ রান; ব্যাটিং গড় ২৯.০০! বল হাতেও সমানে কার্যকরী ছিলেন এই অফ স্পিনার। ২০.৯০ গড়ে নিয়েছিলেন ৮০ উইকেট!
বুঝতেই পারছেন, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের মিরাজ আর আন্তর্জান্তিক ক্রিকেটের মিরাজের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ । এটা অবশ্যই ঠিক, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মোটেই এক নয়। কিন্তু এতোটাও তো ভিন্ন নয় যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে মিরাজের ব্যাটিং গড় হয়ে যাবে বিশেষজ্ঞ বোলারের বোলিং গড়ের মত; আর বোলিং গড় হয়ে যাবে বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং গড়ের মত!
দেশের মাটিতে মিরাজ খেলেছেন ৯ ওয়ানডে। এই ৯ ওয়ানডেতে তাঁর ব্যাটিং আর বোলিং গড় যথাক্রমে ৭ আর ২৪.৭৮! ব্যাটিং গড়ের কথা বাদ দেওয়া গেল, ধরে নিলাম দল তাকে খেলাতে চাইছে বিশেষজ্ঞ অফ স্পিনার হিসেবে। তা আমাদের এই বিশেষজ্ঞ অফ স্পিনারের দেশের বাইরে বোলিং গড় মোটামুটি বিরাট কোহলির ব্যাটিং গড়ের কাছাকাছি- ৪৯.১৫! অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে যেটা ছিল ১৯.৪৪!
অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে অফ স্পিনার হিসেবে মিরাজ ছিলেন যেকোন কন্ডিশনে কার্যকরী এক বোলার, কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে তিনি হয়ে গেলেন ‘হোম ট্রাক বুলি’ । নাহ, ভুল বললাম মনে হয়। ৯ ম্যাচে ১৪ উইকেট নেওয়া কাউকে তো হোম ট্রাক বুলিও বলা যায় না!
এখন, বড় প্রশ্ন দুটো। এক, মিরাজ এভাবে কতদিন টিকে থাকবেন? দুই, মিরাজ এভাবে ফ্যাকাশে কিভাবে হয়ে গেলেন?
দুই নম্বর প্রশ্নটার উত্তর অবশ্য খুবই সোজা। মিরাজের এভাবে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার পেছনে মিরাজের যেমন দায় আছে, তেমনি দায় আছে দলেরও। তবে দলের যেটুকু দায়ের কথা বলা যায়, সেটা ঠিক ‘দায়’ বলা যায়না। একটু খুলে বলা যাক।
অভিষেকের পর থেকে দল মিরাজকে খেলাত চাইছে অফ স্পিনার হিসেবে। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের সেরা অলরাউন্ডারটিকে দলে অফ-স্পিনার হিসেবে খেলানো হতেই পারে, এটা তো অন্যায় না। তবে সমস্যা হল, মিরাজ যখন দলের চাহিদা মাফিক শুধু অফ স্পিনারই থেকে যান আর ভুলে যান কি দারুণ কার্যকরী এক অলরাউন্ডার হতে পারতেন তিনি।
এই অফ স্পিনার হলেও ঠিক ছিল, যদি তিনি অনুর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের মত যেকোন কন্ডিশনের কার্যকরী এক স্পিনার হতে পারতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তিনি দেশের বাইরে শুধু অকার্যকরই নয়, রীতিমত অগ্রহণযোগ্য। এটাতে দল যে দায়টুকু দেখতে পারে সেটা হল, বেশিরভাগ সময় দল চাইতো মিরাজ মাঝের ওভারগুলোতে রান আটকে রাখবেন। বাংলাদেশ দলে স্ট্রাইক বোলার বা উইকেট টেকিং এর পরিকল্পনায় থাকা বোলারের অভাব ছিল না। মিরাজকে তাই ব্যাবহার করতে চাইত রান আটকানোর কাজে। মিরাজ যে এতে সফল তা তো ৪.৬৫ ইকোনমিতেই বোঝা যায়।
কিন্তু, মিরাজ কি শুধুই রান আটকানোর বোলার? মোটেও না। মিরাজের নিজের যোগ্যতা ছিল দলের মূল বোলার হবার, স্ট্রাইক বোলার হিসেবে দলে খেলার। কিন্তু তিনি দলের চাহিদা মানতে গিয়ে শুধু রান আটকানোর দিকে মনোযোগ দিলেন। এতে অবশ্য দলে তাঁর জায়গা পাকা হয়েছে, জঘন্য বোলিং গড় নিয়েও তিনি ম্যাচের পর ম্যাচ খেলে যাচ্ছেন। কিন্তু এর বিপরীত দিকও আছে।
ঐ যে প্রথম প্রশ্নটা করলাম। মিরাজ এভাবে কতদিন টিকে থাকবেন? দলে এক সময় এখন যারা উইকেট টেকিং বোলার আছে তাঁদের সময় শেষ হয়ে যাবে। তখন আমাদের স্ট্রাইক বোলার লাগবে। তখন মিরাজ সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারলে হয়তো দল তাকে আর রাখবে না। কিংবা, যদি ধরেও নিই তখনও তিনি দলে খেলবেন রান আটকানোর বোলার হিসেবে। এতেও কিন্তু, অনুর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের বিশ্বকাপসেরা খেলোয়াড়কে ক্যারিয়ার শেষ করতে হবে সাদামাটা এক ক্যারিয়ার নিয়ে।
এমন মিরাজকে কি আমরা চেয়েছিলাম?