উনিশে বিশ্বজয় হয়নি। হয়নি কোনো বিস্ময়ের উপলক্ষ্যও। দলগত ব্যর্থতায় নতজানু হয়ে সেবারের ১০ দলের বিশ্বকাপে অষ্টম হয়ে বাড়ি ফিরেছিল বাংলাদেশ। তবে সেবার পুরো বিশ্বকাপে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটারই।
ওলট পালট করে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের রেকর্ডবুককে। অনুজ্জ্বল বাংলাদেশ দলের মধ্যে সেবারের বৈশ্বিক মঞ্চে দীপ্তি ছড়ানো সেই উজ্জ্বল তারকার নাম সাকিব আল হাসান।
৯ ম্যাচের মধ্যে ৩ টিতে জয়। তার বিপরীতে ৫ টি হার আর ১ টি ম্যাচ পরিত্যাক্ত। ২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সামগ্রিক চিত্র ছিল এমনই। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দারুণ শুরু করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই বিশ্বকাপ মিশন শেষ করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে।
কিন্তু ব্যর্থ বিশ্বকাপের সেই মিশনেই সাকিব কাটিয়েছিলেন তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময়। ব্যাটিং, বোলিং- দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন সব খানেই। ১১ জনের ক্রিকেটে সাকিব যেন সেবার একাই আবর্তিত হয়েছিলেন পুরোদস্তুর ব্যাটার ও বোলিং; দুই ভূমিকাতেই। অবশ্য ক্যারিয়ার জুড়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিবের ভূমিকা ছিল এমনই। ব্যাট হাতে যেমন সাবলীল, তেমনি বল হাতে যেন প্রতিপক্ষের জন্য মরণাস্ত্রের এক নাম।
তবে ২০১৯ বিশ্বকাপটা সাকিবের জন্য ছিল নিন্দুক থেকে সমর্থক, আলোচক থেকে বিশ্লেষকদের ভাবনাকেও ছাপিয়ে দেওয়ার মঞ্চ। কেমন ছিল সাকিবের পারফরম্যান্স? বলাই বাহূল্য, ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব যা করেছেন, তা আর কখনো করে দেখাতে পারেননি কেউ।
৫ ফিফটি আর দুই সেঞ্চুরিতে ৮ ইনিংসে ৬০৬ রান। সাথে বল হাতে ১১ টা উইকেট। ঐ বিশ্বকাপেই বিশ্ব প্রথমবারের মতো ৬০০+ রান আর ১০+ উইকেটের বিরল কীর্তির স্বাক্ষী হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিভিন্ন কীর্তি নির্ধারক সাকিব যেন এ বিশ্বকাপে সব গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠলেন চোখ কপালে তোলার মতো কীর্তির নায়ক।
৮ ম্যাচের ৭ টিতেই পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস। যে একটি ম্যাচে তিনি পঞ্চাশ ছুঁতে পারেননি, সেই ম্যাচে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৪১ রান। যুক্ত করা শ্রেয়, ২০১৯ বিশ্বকাপে সেটিই ছিল সাকিবের ব্যাটে খেলার সর্বনিম্ন রানের ইনিংস।
সাকিবের এমন অতিমানবীয় বিশ্বকাপ ফর্মের সূচনা শুরুর ম্যাচ থেকেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ। শুরুটা ভালই করেছিল বাংলাদেশ। তবে হঠাতই ছন্দপতন। ফিরে যান দুই ওপেনারই।
এমন অবস্থায় উইকেট বাঁচানোই মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। কিন্তু সাকিব হেঁটেছিলেন ভিন্ন পথে। এসেই প্রোটিয়া পেসারদের উপর শুরু করেছিলেন পাল্টা আক্রমণ। সাকিবের সেই সাবলীল ব্যাটিংয়েই বড় রানের একটা ভিত্তি পেয়েছিল বাংলাদেশ।
শতকের পথে হেঁটেও যদিও ৭৫ রানে থেমেছিলেন তবে দল পৌঁছে গিয়েছিল ৩৩০ রানের চূড়ায়। ফলাফল, এমন বড় সংগ্রহ ছুঁড়ে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ব্যাটের পরে বোলিং প্রান্তে এসে ১ উইকেট তুলে নিয়ে সে ম্যাচ জয়ের নায়ক ছিলেন সাকিবই।
সাকিবের নায়কোচিত পারফর্ম্যান্সের শুরু সেখান থেকেই। এরপর থেকে দল খেই হারালেও হারায়নি সাকিব নামক আগ্রাসনের তীব্রতা। সতীর্থদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন নিজের অতিমানবীয় ফর্ম দিয়েও। তাই তো, সেবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পাওয়া ৩ জয়ের তিনটিতেই ম্যাচসেরা হয়েছিলেন সাকিব। আর যে ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশ পেরে ওঠেনি, সাকিবের চোখেমুখে আর ব্যাটিং আগ্রাসনে ছিল শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের অন্তর্দৃষ্টি।
সাকিবের এমন একাধিপত্তেও সেবার বাংলাদেশ তেমন কিছু অর্জন করে আনতে পারেনি। সেমির স্বপ্ন মিলিয়ে গিয়েছিল বাকিদের ব্যর্থতায়। তবে কীর্তিতে, রেকর্ডে সাকিব সেবার নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে প্রথম ফাইফারের কীর্তি এসেছিল সাকিবের কাছ থেকে।
শুধু তাই নয়, সে ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ফাইফারের আগে ব্যাট হাতে একটি ফিফটিও করেছিলেন তিনি। আর তাতেই ফিফটি ও ফাইফারের কীর্তিতে যুবরাজ সিংয়ের পাশে নাম লেখান সাকিব। আর বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ডারের আসনে তো তিনি উঠে আসেন এই বিশ্বকাপ দিয়েই।
বিশ্বকাপের ইতিহাসের ১০০০ এর বেশি রানের পাশাপাশি ৩০+ উইকেটের কীর্তি রয়েছে শুধুমাত্র সাকিবেরই। চার বিশ্বকাপ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত সাকিবের রান ১১৪৬ আর উইকেট ৩৪ টি।
২০২৩ বিশ্বকাপই খুব সম্ভবত সাকিবের শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে। কিংবদন্তির তালিকায় আগেই নাম ওঠা সাকিব নিশ্চয়ই এবার ভিন্ন কিছু করার দিকে চোখ রেখেছেন। বিশ্বজয়ের ভাবনাও সাকিবের জন্য অতিরঞ্জিত কিছু নয়। অভাবনীয় সব রেকর্ড গড়েই তিনি বাইশ গজে দাপুটে রাজত্ব দেখিয়েছেন বছরের পর বছর। তাই বিশ্বকাপের স্বপ্ন মোটেই বাড়াবাড়ি কিছু নয়।
আর সেটি না হলেও তো সাকিবের গ্রেটনেস একটুও কমে না। ইয়ান বোথাম, জ্যাক ক্যালিসরাও বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের স্বাদ পাননি। তাতে ক্রিকেট ইতিহাসে তাদের গ্রেটনেস একটুও মুছে যায়নি। সাকিবও বিশ্ব ক্রিকেটে এমনই এক চরিত্র। বাংলাদেশ তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসেও তিনি থেকে যাবেন কিংবদন্ত্ হয়ে, স্মরণীয় এক চরিত্র হিসেবে।