ইউরোপীয় ফুটবলের ট্রান্সফার উইন্ডো মানেই হইচই অবস্থা।
বড় দলগুলো পয়সা নিয়ে নামে নিজেদের পছন্দের খেলোয়াড়কে কিনতে। আবার সেলিং ক্লাবগুলো চিন্তায় থাকে তাদের সেরা খেলোয়াড়কে কত বেশি দামে গছানো যায়। কিন্তু শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোটা একটড়ু আলাদা। এখানে টাকার বস্তা নিয়ে নামার বদলে ক্লাবগুলো চিন্তার থাকে তাদের নিজেদের শক্তি বাড়াতে কিংবা দুর্বলতা কমাতে।
ছোট দলগুলোও নিজেদের লাভের কথা না ভেবে চায় খেলোয়াড়কে ধরে রেখে মৌসুম ভালোভাবে শেষ করতে। কিন্তু ‘ডেডলাইন ডে’ বলে কথা। মেলার শেষে যেমন ঢল নামে ক্রেতাদের, কম দামে ভালো জিনিসটা বুঝে নিতে; তেমনই ট্রান্সফার মার্কেটের ‘ডেডলাইন ডে’তে ক্লাবগুলো ঝাপিয়ে পড়ে নিজেদের দুর্বলতা ঢেকে ফেলতে। এর মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে ইউরপীয়ান ফুটবলে কেনা-বেচার মৌসুম।
পুরো ট্রান্সফার উইন্ডোতে বড় খরচ না করা অনেক দলই ‘ডেডলাইন ডে’ তে এসে চেষ্টা করেছে কম দামে ভালো কিছু কিনে নেওয়ার। গত রাতে শেষ মুহূর্তের চুক্তিগুলোই দেখে নেওয়া যাক এক নজরে।
মৌসুমের শুরু থেকেই লিভারপুলের চোটভাগ্য বেশ চড়া। মূল তিন ডিফেন্ডারকে (ভার্জিল ফন ডাইক, জোয়েল মাতিপ ও জো গোমেজ) পুরো মৌসুমের জন্য বিদায় বলতে হয়েছে তাদের। যদিও কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ ভাবছিলেন মেইক-শিফট ডিফেন্ডার দিয়ে কোনোভাবে চালিয়ে নিতে পারবেন বাকি মৌসুমটা, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায়ই পঁচা শামুকে পা কাটার মতন অবস্থা। তাই ক্লপ আর রিস্ক নেননি। মিডফিল্ডার, ইয়ুথ টিমের ডিফেন্ডারদের বদলে একেবারে পাকা ডিফেন্ডারই কিনে এনেছেন ক্লপ। যদিও বোর্ড প্রথমে কিছুটা চাপ দিচ্ছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত দলের অবস্থা দেখে দুই ডিফেন্ডারকে কেনার বাজেট দিয়ে দিয়েছেন ‘দ্যা নরমাল ওয়ান’কে।
শেষ সময়ে হাতে পয়সাকড়ি পেয়ে ক্লপের প্রথম ক্রয় ছিল তুর্কি ডিফেন্ডার ওজান কাবাক। গত তিন বছরে তিন দল ঘুরে শালকে ০৪ থেকে লিভারপুলে পাড়ি জমিয়েছেন এই ২০ বছর বয়সী তারকা। আপাতত ১০ লাখ (১ মিলিয়ন) পাউন্ডের বিনিময়ে আগামী জুন পর্যন্ত ধারে এসেছেন। তবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে পাকাপাকিভাবে তাকে দলে টেনে নেওয়ার সুযোগও আছে ক্লপের কাছে। সেক্ষেত্রে ১৮ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে তাঁকে দলে আনতে পারবে লিভারপুল।
কাবাকের উপর ভরসা করেই ক্ষান্ত হননি ক্লপ। ইংলিশ লিগের এক্সপেরিয়ান্সের উপর ভরসা করে প্রেস্টন নর্থ এন্ডের বেন ডেভিসকে কিনেছেন ক্লপ। ২৬ বছর বয়সী ওয়েলশ ডিফেন্ডারের আগে কখনও ইংলিশ ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ হয়নি। তাকে কিনতে আপাতত পাঁচ লাখ পাউন্ড খরচ হলেও সব শর্ত পূরণ করতে পারলে ১.১ মিলিয়ন পাউন্ড পকেটে পুরতে পারবে প্রেস্টন।
লিভারপুল যে শেষদিনে শুধু কিনেইছে তা কিন্তু নয়। শেষদিনে এসে জাপানিজ উইঙ্গার তাকুমি মিনামিনোকে সাউদাম্পটনে ধারে পাঠিয়েছে লিভারপুল। দুই ডিফেন্ডার কেনার পর হেন্ডারসন আর মিলনারকে জায়গা দিতে হবে মাঝমাঠে। আর সেজন্য একাদশে জায়গা করে নিতে বেশ কষ্ট করতে হতো মিনামিনোকে। গত জানুয়ারিতে কেনা মিডফিল্ডারকে তাই আগামী ছয় মাসের জন্য ধারে পাঠিয়েছে ‘অল রেড’রা। চুক্তি শেষ হওয়ার পর অবশ্য তাকে আবার লিভারপুলেই ফিরতে হবে।
মার্সিসাইডের অন্য ক্লাব এভারটনও বসে থাকেনি। কোচ কার্লো আনচেলত্তির অধীনে বেশ ভালো ফর্মে আছে ‘দ্যা টফিম্যান’রা। জানুয়ারিতে তাদের মূল স্ট্রাইকার ডমিনিক লুইস কালভার্টের চোট তাদের পিছিয়ে দিয়েছে বেশ ভালোভাবে। তাই মৌসুমের বাকিটা সময়ের জন্য বোর্নমাউথের স্ট্রাইকার জশুয়া কিংকে দলে ভিড়িয়েছে এভারটন। যদিও এই মৌসুমে তেমন ফর্মে নেই কিং, তবুও নতুন দলে আনচেলত্তির অধীনে ফিরতেও পারেন।
শেষদিনে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের বিক্রির খাতা আরো বড় করেছে। জেসে লিংগার্ডের পর মার্কোস রোহোকেও তারা ছেড়ে দিয়েছে একদম ফ্রিতে। ২০১৪ বিশ্বকাপের তারকাকে বেশ আশা নিয়েই কিনেছিল তারা। কিন্তু চোটের কারণে সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। এই মৌসুমে অসাধারণ ফর্মে থাকা লুক শ আর অ্যালেক্স টেলেসের বদলে সুযোগ পাওয়া ছিল অসম্ভব। তাই আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে যোগ দিয়েছেন রোহো।
আর্সেনালও ধারে বিদায় বলেছে তাদের ইয়াং প্রডিজি মাইটল্যান্ড-নাইলসকে। গত মৌসুমে বেশ ভালোই সুযোগ পাচ্ছিলেন, কিন্তু রাইটব্যাকের বদলে মাঝমাঠে খেলতে চাওয়ার পণ করে দলে পাওয়াই যাচ্ছে না তাকে। অবশেষে ওয়াস্ট ব্রম আলবিয়নের কাছে ছয় মাসের জন্য ধারে পাঠিয়েছে আর্সেনাল।
শেষদিনে নিজেদের সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার শকোদ্রান মুস্তাফিকেও ছেড়ে দিয়েছে আর্সেনাল। কন্ট্রাক্ট টার্মিনেট করে তিনি যোগ দিয়েছেন জার্মান ক্লাব শালকে ০৪-এ।
শেষদিনে আরেক জার্মান ক্লাব হার্থা বার্লিনে যোগ দিয়েছেন সামি খেদিরা। আর্থার, ম্যাকেনজি আর চিয়েসাকে কেনার পর নতুন কোচ আন্দ্রেয়া পিরলো একপ্রকার সাইডলাইনেই বসিয়ে দিয়েছিলেন খেদিরাকে। বিশ্বকাপজয়ী তারকা তাই ফ্রি ট্রান্সফারে যোগ দিয়েছেন বার্লিনের পুরাতন এই ক্লাবের। তাঁর সাথে সাথে সার্বিয়ান উইঙ্গার নেমানিয়া র্যাডজোনিককেও ভিড়িয়েছে তারা।
বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদ পুরো ট্রান্সফার উইন্ডোতে চুপ করে বসে থাকলেও শেষদিনে এসে কিছু তোড়জোড় দেখিয়েছে। রিয়াল পুরো মৌসুমজুড়েই ধারে পাঠিয়েছে খেলোয়াড়দের, বার্সাও সে পথে পা বাড়িয়েছে। দুই মৌসুম আগে ফ্রিতে কিনে আনা জিন-ক্লেয়ার তোলিবোকে ধারে ফ্রেঞ্চ ক্লাব নিসে পাঠিয়েছে তারা। মৌসুম শেষে চাইলে ১০ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে কিনেও নিতে পারবে তারা।
শেষদিনে বহু চেষ্টা করেও মাউরিসিও পচেত্তিনো কিনতে পারেননি ডেলে আলিকে। পিএসজিতে যাওয়ার পর থেকেই নিজের প্রিয় খেলোয়াড়কে কিনতে বেশ চাপ দিচ্ছিলেন দলকে। কিন্তু শেষদিনে কেনার অনেক কাছাকাছি গিয়েও হার মানতে হয়েছে জোসে মরিনহোর তাকে ধরে রাখার প্রজ্ঞার কাছে। অন্যদিকে কোচ মাউরিজিও সারি নাকচ করে দিয়েছেন ফ্রেঞ্চ লিগ থেকে আসা কোচিং করার দুই অফার।