তোমার কিসের এত তাড়া!

এখানে তাঁর জন্য কোন ‘ডিআরএস’ অপেক্ষারত ছিলনা। ৪৭ বছর পূর্ণ হবার দিন পঁচিশেক আগেই গাড়ি দুর্ঘটনায় চিরতরে হারিয়ে গেলেন বুকের কাছাকাছি থাকা একটা ক্রিকেটসময়ের অঙ্গ হয়ে থাকা এক চিররঙ্গীন বোহেমিয়ান অজি ক্রিকেটার, তাঁর সমস্ত ভালো-মন্দ পিছনে ফেলে রেখে। খবর, তাঁর পোষ্য সারমেয়রা তীব্র বাধা দিচ্ছিল তাঁর মৃতদেহ শেষবারের মত নিয়ে যাবার আগে।

‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লাইনটাই অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে সবচেয়ে ভালো বোঝাতে পারে।

সাইমন্ডস ছিলেন একজন ক্যারিবিয়ান কিন্তু তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ দম্পতি। ১৯৭৬ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডের বার্মিংহ্যাম শহরে। তারপরে পরিবারের সঙ্গে তিনি চলে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। মাছ ধরা ছিল “রয়”-এর প্রথম নেশা, পেশা ক্রিকেটেরও আগে।

বহুবার সতর্কিত হবার পরেও মূলত মাছ ধরার নেশার কারণেই সময়ের বহু আগে ক্রিকেটের পেশায় থামতে হয়েছিল এই দুরন্ত অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডারকে। ক্রিকেট জীবন শেষ হয়েছিল যে মাছ ধরার নেশায়, তাকেই আঁকড়ে থেকেছেন পরে বাকি জীবন জুড়ে। এ নিয়ে কোন অনুতাপ অবশ্য ছিল না তাঁর।

সালটা ছিল ২০০০। সবে বছরদুয়েক হলো, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছেন তিনি। আর বছর পাঁচেক আগে ১৯ বছর বয়সে কাউন্টি অভিষেকের বছরে গ্লস্টারশায়ারের হয়ে গ্ল্যামারগনের বিরুদ্ধে তাঁর এক ইনিংসে ১৬টি ছয় মারার (সঙ্গে ২২টি চার-ও) একটি রেকর্ড ছিল বহু বছর। জনশ্রুতি, ১৬ নম্বর ছয়টি গিয়ে পড়েছিল মাঠের বাইরের টেনিস কোর্টে।

গ্লস্টারশায়ারের রান যখন ৭৯/৪, সেই অবস্থায় ব্যাট করতে নেমে ৭৯/৫ হয়ে যাওয়ার পর প্রতি আক্রমণ শুরু করেছিলেন ‘টাইগার শার্ক’। প্রথম দিন ১৯৭ রানে অপরাজিত থাকার পরে দ্বিতীয় দিন করেন ২০৬ বলে ২৫৪ রান। গ্লস্টারশায়ারকে পৌঁছে দেন সুবিধাজনক অবস্থায়। সেবার প্রি সিজন ক্যাম্প শুরু হওয়ার অনেক পরে ক্যাম্পে যোগ দিয়েও ফিটনেসে সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন সাইমন্ডস।

ওই ২০০০ সালেরই একটি ঘটনা আছে ‘রয়’-তে। সাইমন্ডস, হেডেন এবং তাঁদের এক বন্ধু কুইন্সল্যান্ডে মাছ ধরতে বেরিয়েছিলেন বোট নিয়ে। বোট জলে রেখে সাঁতার কাটতে নেমেছিলেন তিন বন্ধু। মাঝদরিয়ায় হঠাৎ চোখের সামনে বোটটি ডুবে যায়। তখন সাঁতরানো ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোন পথ খোলা ছিল না।

এবং সেই জায়গাটা ছিল হাঙ্গর অধ্যুষিত। হেইডেন ছিলেন পাকা সাঁতারু। বন্ধুদের সেদিন দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটার কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন হেডেন। তিন ঘণ্টা পর একটা দ্বীপে উঠেছিলেন তারা। সে যাত্রায় হাঙর ভাগ্যক্রমে ছোঁয়নি সাইমন্ডসদের। কিন্তু তার বাইশ বছর পরে ১৫ মে ২০২২ তারিখে মৃত্যু ছুঁয়েই ফেলল অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে।

তাঁর বিহনে গভীর শোকাহত ক্রিকেটবিশ্ব। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের টুইট ‘খুব বিশ্বাসী এবং আনন্দপ্রেমী বন্ধুর কথা মনে পড়ছে যে সব কিছু করতে পারতো বন্ধুর জন্য। এটাই রয়।’ অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট এর চেয়ারম্যান ল্যাচলান হেন্ডেরসন বলেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট তার আরো একজন সেরাকে হারালো।’

২০০৮ সালের সিডনি টেস্টে কুখ্যাত ‘মাঙ্কিগেট’-এর পরে তার পরম শত্রু (মিটে গিয়েছিল অল্প দিনেই) হরভজন সিংয়ের টুইট, ‘অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের মৃত্যুতে আমি হতভম্ব। খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলে। ওর পরিবার ও বন্ধুদের সমবেদনা জানাই। আত্মার শান্তি কামনা করি।’ শোক টুইট করেছেন বিরাট কোহলি, যজুর্বেন্দ্র চাহালও।

১৯৯৮-২০০৯, এই ১২ বছরের ক্রিকেটজীবনে ২৬টি টেস্টে ৪০.৬১ ব্যাটিং গড়ে ১,৪৬২ রান (২টি শতরান) ও ২৪ উইকেট, ১৯৮টি ওডিআইতে ৩৯.৭৫ গড়ে ৫,০৮৮ রান (৬টি শতরান) ও ১৩৩ উইকেট এবং ১৪টি টি২০ ম্যাচে ১৬৯.৩৪ স্ট্রাইক রেটে ৩৩৭ রান ও ৮ উইকেটের মালিক, ঠোঁটভর্তি জিঙ্ক ক্রিম মেখে মাঠে নামা, ‘মাঙ্কিগেট’-এ বহু আলোচিত অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের ডাকনাম অনুযায়ী তাঁর আত্মজীবনীর নাম ছিল ‘রয়’।

যার সহ লেখক ছিলেন স্টিফেন গ্রে। ইনফিল্ডে কভার বা মিড-উইকেট পজিশনে তাঁর দুরন্ত ফিল্ডিং আর অব্যর্থ উইকেটে ছোঁড়ার জন্য প্রাক্তন অধিনায়ক রিকি পন্টিং তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘টাইগার শার্ক’। ২২, ৮২ ও ৩টি ক্যাচ ধরেছিলেন তিনি, যথাক্রমে টেস্টে, ওডিআইতে আর টি-টোয়েন্টি ম্যাচে। আর কত রানআউটের পিছনে যে তাঁর ডানহাত দায়ী ছিল, তা জানে ওই সময়ের ক্রিকেট উৎসাহীরা।

দুটি বিশ্বকাপ খেলে (২০০৩, ২০০৭) দু’টোই জিতেছেন, নিজের অবদান সমেত। ১৩ টি ম্যাচ খেলে করেছেন ৫১৫ রান, ১টি শতরানসহ। এবং সঙ্গে ৫ উইকেট ও ৭টি ক্যাচ। ২০০৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়াসিম-ওয়াকার-শোয়েব-শাহিদকে পিটিয়ে সাইমন্ডসের ১২৫ বলে অপরাজিত ১৪৩-কে (২টি ৬, ১৮টি ৪) আজও বিশ্বকাপের একটি প্রথম সারির ইনিংস মানা হয়।

আর কুইন্সল্যান্ডের হয়ে শেফিল্ড শিল্ড খেলা ছাড়াও গ্লস্টারশায়ার, কেন্ট, ল্যাঙ্কাশায়ার ও সারে দলের হয়ে কাউন্টি খেলেছিলেন সাইমন্ডস। আইপিএলে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন ডেকান চার্জাস (২০০৮-২০১০) এবং মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স (২০১১) দলের হয়ে। ২০০৯ সালে আইপিএল জিতেছিল ডেকান চার্জাস। ২০০৮-২০১১, এই চার বছর আইপিএল খেলে ৩৯ ম্যাচে তার রান ছিল ৯৭৪ (একটি শতরান), উইকেট নিয়েছিলেন ২০টি।

বড্ড তাড়াহুড়ো ছিল তাঁর ক্রিকেটে, আচরণে, জীবনে। সেই তাড়াহুড়োয় ‘কনসিসটেন্ট’ রইলেন তিনি মৃত্যুতেও।হার্ভে রেঞ্জ রোডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন নিজেই, আর কেউ ছিলেন না গাড়িতে। অ্যালিস রিভার ব্রিজে বাঁক নেওয়ার সময় গাড়িটি উলটে যায় এবং কয়েকটি পাকও খেয়ে যায়। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম এগিয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করলেও শরীরের ভয়ানক চোট আর ফিরতে দেয়নি ‘রয়’কে।

এখানে তাঁর জন্য কোন ‘ডিআরএস’ অপেক্ষারত ছিলনা। ৪৭ বছর পূর্ণ হবার দিন পঁচিশেক আগেই গাড়ি দুর্ঘটনায় চিরতরে হারিয়ে গেলেন বুকের কাছাকাছি থাকা একটা ক্রিকেটসময়ের অঙ্গ হয়ে থাকা এক চিররঙ্গীন বোহেমিয়ান অজি ক্রিকেটার, তাঁর সমস্ত ভালো-মন্দ পিছনে ফেলে রেখে। খবর, তাঁর পোষ্য সারমেয়রা তীব্র বাধা দিচ্ছিল তাঁর মৃতদেহ শেষবারের মত নিয়ে যাবার আগে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...