ধোনি রিভিউ সিস্টেম, মিথ বনাম বাস্তবতা

অনফিল্ডের ধোনি কি সব খানেই সফল? শিরোপা সফলতায় কি তাঁর কোনো ব্যর্থতা আড়ালে পড়ে যায়? নামটা 'ধোনি' বলেই কিছু ব্যাপার পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বে চলে যায়? এমন সব প্রশ্নের জট খোলা যাক।

ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক— মহেন্দ্র সিং ধোনির বেলায় সম্ভবত এমন বিশেষণই সর্বজন স্বীকৃত। ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র সর্বজয়ী অধিনায়ক। দারুণ গেমসেন্স, সাথে ম্যাচ পরিস্থিতিতে হুটহাট সিদ্ধান্তে ম্যাচের ফল বের করার ব্যাপারে ধোনির জুড়ি নেই। অধিনায়কত্ব অনেক কিছুর সংজ্ঞা মেনে চলে। কিন্তু ধোনি সেই সংজ্ঞাটা যেন নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং করছেনও।

তবে অনফিল্ডের ধোনি কি সবখানেই সফল? শিরোপা সফলতায় কি তাঁর কোনো ব্যর্থতা আড়ালে পড়ে যায়? নামটা ‘ধোনি’ বলেই কিছু ব্যাপার পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বে চলে যায়? এমন সব প্রশ্নের জট খোলা যাক। তার আগে চলুন রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে চেন্নাইয়ের শেষ ম্যাচের একটা দৃশ্যপটে ঘুরে আসা যাক।

ম্যাচের তখন চতুর্থ ওভার চলছে। আগের ৩ ওভারে বাটলার, জেসওয়াল ব্যাটিং তোপে চেন্নাইয়ের বোলাররা হজম করেছে ৪২ রান। তাই ধোনিকেও বাধ্য হয়ে বোলিং পরিবর্তন করতে হল। তুষার দেশপাণ্ডের জায়গায় তিনি বোলিংয়ে আনলেন মাহিশ থিকশানাকে। আর থিকশানার করা সেই ওভারের তৃতীয় বলেই সুইপ শট খেলতে গিয়ে ব্যর্থ হন জেসওয়াল। বল লাগে প্যাডে। থিকশানা এলবিডব্লিউয়ের আবেদন করলেন। আম্পায়ার তাতে আর সাড়া দিলেন না।

এমতাবস্থায় রিভিউ নিলেন উইকেটের পিছনে থাকা ধোনি। থিকশানার সেই বলটি আউটসাইড লেগ স্ট্যাম্প বরাবর যাচ্ছিল, তা প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ধোনি কেন সেটিতে রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন তা অনেকেরই বোধোদয় হলো না। কমেন্ট্রি বক্স থেকে তা নিয়ে এমন কিছুরই সুর ভেসে আসছিল। যা হোক, পরবর্তীতে টিভি রিপ্লেতে স্পষ্টভাবেই দেখা গেল, বলটা আউটসাইড লেগের বাইরে ছিল। ফলত, চেন্নাইয়ের সে রিভিউ বিফলে যায়। ব্যর্থ হন ধোনিও।

প্রসঙ্গটা যখন ডিসিশন রিভিউ সিস্টেমের (ডিআরএস), তখন এমন ব্যর্থতার বৃত্তে ধোনি বেশ ক’বারই ঘুরপাক খেয়েছেন। কিছুটা বিস্ময় জাগালেও, ডিআরএসে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে ধোনি শীর্ষদের কাতারেও নেই! ক্রিকেট ডেটা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ক্রিকভিজ অন্তত সেই তথ্যই জানাচ্ছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেটে ন্যূনতম ১ টি করে রিভিউ নেওয়া ১৩২ টা অধিনায়ককে নিয়ে এই গবেষণা চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

তো ক্রিকভিজের এ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ১৩২ অধিনায়কের মধ্যে ৪১ অধিনায়ক ২০ বা তার বেশি রিভিউ কল করেছে। সর্বোচ্চ রিভিউ কল করার দিক দিয়ে শীর্ষে আছেন বাবর আজম। তিনি এখন পর্যন্ত ১৭২ টি রিভিউ নিয়েছেন। এরপর জোর রুট ১৬২ বার, বিরাট কোহলি ১৪৪ বার দিমুথ করুণারত্নে ১২৪ বার রিভিউ নিয়েছেন।

২০ বা তার বেশি রিভিউ নিয়ে সফলতার হার বিবেচনায় এগিয়ে আছেন ফাফ ডু প্লেসি। রিভিউ নেওয়ার বেলায় তাঁর সফলতার হার ৫৭ ভাগ। আর সবচেয়ে কম সফলতা পেয়েছেন নিকোলাস পুরান। তাঁর সফলতার হার মাত্র ২১ ভাগ।

স্যাম্পল সাইজটা যদি ১০ রিভিউ কলে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে আবার শীর্ষে থাকবেন দিনেশ চান্দিমাল আর এইডেন মারক্রাম। তাদের দুজনের সফলতার হারই ৬৩ ভাগ। অপরদিকে, ১০ রিভিউ কলের বিবেচনায় মাত্র ১৪ ভাগ সফলতা নিয়ে রিভিউ কল নেওয়ার ক্ষেত্রে এক প্রকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন ওয়াহাব রিয়াজ।

এবার দেখা যাক, রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে ধোনি ঠিক কতটা সফল। এখন পর্যন্ত আইপিএলে ২২ বার রিভিউ নেওয়া এ অধিনায়ক মোট ৯ বার সফল হয়েছেন। অর্থাৎ রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে ৪১ ভাগ সফলতা পেয়েছেন ধোনি। যা ফাফ ডু প্লেসি তো বটেই, লোকেশ রাহুল, বেন স্টোকস, আজিঙ্কা রাহানে, বিরাট কোহলির চেয়েও কম সফলতা নির্দেশ করে।

সিংহভাগ সময়েই উইকেটরক্ষকদের কাছ থেকে মূলত রিভিউ কলটা আসে। তো এমন পরিসংখ্যানে, সবার চেয়ে চেয়ে এগিয়ে ঋষাভ পান্ত। ভারতের এ উইকেটরক্ষকের নেওয়া রিভিউ কলে দল ৬০ ভাগ সফল হয়েছে। পান্তের বিপরীতে উইকেটরক্ষক হিসেবে মাত্র ২৫ ভাগ সফল হয়ে এই তালিকায় সবার নিচে আছেন মোহাম্মদ রিজওয়ান।

তো, উইকেটরক্ষকের রিভিউ কল নেওয়া বিবেচনায় ধোনি এই তালিকায় কোন অবস্থানে রয়েছেন? অবাক করা ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের সরফরাজ আর রিজওয়ান ছাড়া ধোনির নিচে আর একজন উইকেটরক্ষকও নেই। অর্থাৎ উইকেটরক্ষক হিসেবে ধোনির এই ৪১ ভাগ সফলতা, রিভিউয়ে সফলদের তালিকায় তাঁকে শেষ পর্যন্ত তলানিতেই রাখছে।

আরেকটা পরিসংখ্যানে চোখ রাখা যাক। বিরাট কোহলি অধিনায়ক থাকার সময় ৭ বার রিভিউ কল নিয়েছিলেন ধোনি। আর অধিনায়ক ব্যতিত ৭(৪-৩) কলের তাঁর সফলতার হার ছিল ৫৭ শতাংশ। কিন্তু তারপরও অন্যান্য উইকেটরক্ষকদের চেয়ে পিছিয়েই থাকছেন ধোনি। যেমন লোকেশ রাহুল অধিনায়ক থাকার সময় উইকেটের পিছনে থেকে লখনৌকে ৮০ ভাগ(৪-১) সফলতা এনে দিয়েছেন কুইন্টন ডি কক।

এ ছাড়া রশিদ খানের অধিনায়কত্বে রহমানুল্লাহ গুরবাজ ১০ বারের কলে ৭ বার সফল হয়েছেন, অর্থাৎ সফলতার হার বিবেচনায় তা ৭০ শতাংশ। এভাবে ডি ভিলিয়ার্স, দিনেশ কার্তিক, বাটলার, নিরোশন ডিকওয়েলা, সাঞ্জু স্যামসন, ঋষাভ পান্ত—  বলতে গেলে নামজাদা সব উইকেটরক্ষকই রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে ধোনির চেয়ে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছেন।

শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে অধিনায়ক ধোনির ধারের কাছেও কেউ নেই। ভারতকে জিতিয়েছেন সম্ভাব্য সকল শিরোপা। এর পাশাপাশই চেন্নাইকে চারবার আইপিএল শিরোপা আর দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফির (বিলুপ্ত) শিরোপা জিতিয়েছেন।

তবে সর্বজয়ী অধিনায়ককেও বোধহয় পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে কোথাও গিয়ে হয়তো থামতে হয়। ধোনির ক্ষেত্রেও হয়েছে এমন। তাঁর অধিনায়কত্বের সাফল্যে ক্রিকেট বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সমর্থকরা এতটাই বুঁদ হয়েছিল যে, রিভিউ কলে তাঁর ব্যর্থতা এতদিন ধরে এক প্রকার আড়ালেই ছিল।

অধিনায়ক ধোনি যেখানে সন্দেহাতীতভাবেই সবার কাছে শীর্ষে, সেখানে রিভিউ কল নেওয়ার ক্ষেত্রে সফলতার হার বিবেচনায় পরিসংখ্যান বলছে, ধোনি এখানে ঠিক ‘ধোনি’র মতো নয়, বরং ব্যর্থদের কাতারেই থাকছেন তিনি।

– উইজডেন অবলম্বনে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...