ফুটবলের উৎপত্তিস্থল ইংল্যান্ড হলেও ফুটবলের স্বর্গ হচ্ছে লাতিন আমেরিকা। আরেকটু সহজ করে বললে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। ১৯৭০ সালের মাঝেই ব্রাজিল তিনবার বিশ্বকাপ জিতে নিজেদের জানান দিলেও আর্জেন্টিনা তখনো ছিল ব্যর্থ।
ফুটবল বিশ্বকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেবার মতো করতে পারেনি কিছুই। অবশেষে ১৯৭৮ সালে এই শিরোপা খরা দূর করেন একজন, ম্যারাডোনার আগমনের পূর্বে যিনি ছিলেন আর্জেন্টাইনদের নয়নের মণি। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে মাত্র পাঁচজন একই বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট এবং গোল্ডেন বল জেতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
তিনি সেই পাঁচ ফুটবল মহামানবের একজন, সমর্থকরা তাকে আদর করে ডাকে ‘এল ম্যাটাডোর’। ঝাঁকড়া চুলের ছিপছিপে গড়নের এই ফুটবলারের নাম মারিও কেম্পেস, পুরো নাম মারিও আলবের্তো কেম্পেস ছিয়োডি।
১৯৫৪ সালের ২৫ জুলাই বুয়েন্স আয়ার্সের বেল ভিন্তের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কেম্পেস। ছোটবেলা থেকেই বাকি আট-দশটা আর্জেন্টাইন বালকের মতো ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ ছিল তার। তবে তার ফুটবলজীবন শুরু হয় বাবার কাছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন অমিত প্রতিভাধর ফুটবলার, মাত্র সাত বছর বয়সেই জায়গা করেন স্থানীয় ক্লাবের জুনিয়র দলে।
১৯৭০ সালে যোগ দেন ইনস্টিটিউটের যুবদলে। কিন্তু তিন বছরে সুযোগ পান মাত্র ১৩ ম্যাচে। সে ম্যাচগুলোতেও বেশিরভাগ সময় নামতেন খেলার একদম শেষের দিকে, তা সত্ত্বেও করেন এগারো গোল। দারুণ গতি, ক্ষীপ্রতা, বলের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং দারুণ ফিনিশিং দিয়ে তিনি নজর কাড়েন বড় ক্লাবগুলোর। ১৯৭৩ সালে যোগ দেন রোজারিও সেন্ট্রালে।
১৯৭৪ বিশ্বকাপ ফুটবল। জুলে রিমে ট্রফি একান্ত নিজের করে নেবার পর নতুন বিশ্বকাপ ট্রফির স্বাদ নিতে হাজির ব্রাজিল। আছে ক্রুইফ আর তার টোটাল ফুটবলের নেদারল্যান্ড। ছেড়ে কথা বলবে না বেকেনবাওয়ারের জার্মানিও। ফুটবলবিশ্বে আর্জেন্টিনা তখন নিতান্তই চুনোপুঁটি।
কিন্তু, ২০ বছর বয়সী মারিও কেম্পেসের চোখে তখন নতুন স্বপ্ন, কিশোর বয়সের দু:সাহসিক ভাবনার মতো উঁকি দিচ্ছে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন দু:স্বপ্নে পরিণত হতে সময় নিলো না। কোনো ম্যাচে গোল তো দূরে থাক বলটাই যেন ধরতে পারলেন না কেম্পেস। ফলাফলস্বরূপ আর্জেন্টিনাও বাদ পড়ে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে।
অথচ রোজারিও সেন্ট্রালের হয়ে গোল করাটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিলেন কেম্পেস। কিন্তু একসময় বুঝতে পারলেন নিজের ক্যারিয়ারকে অন্য উচ্চতায় নিতে এবং বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে ইউরোপে পাড়ি জমানোর বিকল্প নেই। তিন বছরে রোজারিওর হয়ে ১০৭ ম্যাচে ৮৫ গোল করার পর তাই পাড়ি জমালেন স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ায়।
সেখানে গিয়ে শুরুর দিকে পড়লেন বিপদে, আর্জেন্টিনার চাইতে স্প্যানিশ ফুটবলের খেলার ধরণ যে আলাদা। পেনাল্টি মিস, বাজে ফিনিশিংয়ের কারণে সমালোচিত হলেন। কিন্তু যার জন্মই হয়েছে আকাশ ছোঁবার জন্য এসব ছোটখাট সমস্যা কি তাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারে।
দ্রুতই ফিরলেন নিজের রূপে, এল ম্যাটাডর হয়ে। প্রথম মৌসুমেই ৩৪ ম্যাচে ২৪ গোল করে জিতলেন পিচিচি ট্রফি। বার্সেলোনা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের মতো জায়ান্টদের পেছনে ফেলে ভ্যালেন্সিয়াকে জেতালেন কোপা দেল রে’র শিরোপা।
১৯৭৮ বিশ্বকাপের স্বাগতিক নির্বাচিত হয় আর্জেন্টিনা। ফুটবলের দেশে তখন ঘোর দুঃসময়, সামরিক স্বৈরশাসকের দেশে তখন চলছে চরম অরাজকতা। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জনগণ নেমে এসেছে রাস্তায়। এমন সময় বিশ্বকাপ হয়ে এল স্বস্তির বাতাস নিয়ে, মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো গোল বলটাকে নিয়ে। ২৪ বছর বয়সী কেম্পেস তখন আরো পরিণত, আরো ধারালো।
পার করছেন ক্যারিয়ারের সেরা সময়, বিশ্বকাপের কদিন আগেই জিতেছেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় পিচিচি ট্রফি। আলবিসেলেস্তেদের কোচ তখন সিজার লুইস মেনোত্তি। মেনোত্তি তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে দল ঘোষণা করলেন, ৭৪’বিশ্বকাপের দল থেকে কেবল ছিলেন কেম্পেস আর গোলরক্ষক উবালদো ফিলোল। কিন্তু সবাইকে আশ্চর্য করে বাদ দিলেন ১৮ বছর বয়সের প্রতিভাবান ম্যারাডোনাকে। হয়তো ফুটবল ঈশ্বর চেয়েছিলেন ৭৮ বিশ্বকাপটা যেন থাকে কেম্পেসের একান্তই একার।
কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতেই যেন পুরনো ফর্মে কেম্পেস, গোল পাননি গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচের একটিতেও। গোল তো দূরে থাক, ম্যাচে তাকে খুঁজে পাওয়াই ছিল দুষ্কর। ইতালির কাছে হেরে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে পরের রাউন্ডে উত্তীর্ণ হলো আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচেই পোল্যান্ডের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা।
সে ম্যাচের প্রথমার্ধেও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে রচিত হলো কেম্পেসের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। ড্যানিয়েল প্যাসারেলার বাড়ানো বলে মাথা ছুঁয়ে বল জালে জড়িয়ে আর্জেন্টিনাকে প্রথম লিড এনে দেন কেম্পেস। এর কিছুসময় পর আরেক কাহিনী করে বসেন। পোল্যান্ডের একটি আক্রমণের সময় গোলপোস্টের সামনে ছিলেন তিনি।
নির্ঘাত গোল হওয়া শটকে তিনি ঠেকিয়ে দেন হাত দিয়ে। যদিও পেনাল্টিতে পোল্যান্ড গোল করতে পারেনি। পেনাল্টি শটটি দারুণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক ফিলোল। আরদিলেসের অ্যাসিস্টে দ্বিতীয় গোলও করেন কেম্পেস। আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে হারায় পোল্যান্ডকে।
দ্বিতীয় ম্যাচে ব্রাজিলের সাথে ড্র করে আর্জেন্টিনা। ফলে ফাইনালে যেতে হলে পেরুর সাথে শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে জিততে হবে অন্তত ৪-০ গোলের ব্যবধানে। পেরু তখন ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তির নাম। বিশ্বকাপের আগের বছর অনুষ্ঠিত হওয়া কোপা আমেরিকাতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপাও জিতে নিয়েছে তারাই।
তাঁদের জালে ৪ গোল দেওয়া আর্জেন্টিনার পক্ষে কতটা শক্ত তা জানতেন মেনোত্তি। সকল আর্জেন্টিনা দর্শকের পাশাপাশি তিনিও প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র আশা হারাননি কেম্পেস। সেই আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে আর্জেন্টিনা পেরুকে হারায় ৬-০ গোলের ব্যবধানে! আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলা ম্যাচে কেম্পেস করেন জোড়া গোল ও জোড়া অ্যাসিস্ট।
ফাইনালে বুয়েন্স আয়ার্স স্টেডিয়ামে নেদারল্যান্ডসের মুখমুখি হয় স্বাগতিকরা। ডাচদের হয়ে সেবার ক্রুইফ না খেললেও ছিলেন বাকিরা। ফাইনালে তাই এগিয়ে ছিল ডাচরাই। ম্যাচের শুরু থেকেই চড়াও হয়ে খেলতে শুরু করে ডাচরা। মুহুর্মুহু আক্রমণ আছড়ে পড়ছিল আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগে। কিন্তু ৩৮ মিনিটে পাল্টে গেল দৃশ্যপট, মাঝমাঠে বল পেলেন কেম্পেস।
কমলা জার্সির ডিফেন্ডারদের ড্রিবলিং করে গোলরক্ষককেও পাশ কাটিয়ে যখন বল ঠেলে দিলেন জালে, মুহূর্তের মাঝে যেন লিখে দিলেন ম্যাচের চিত্রনাট্য। কিন্তু স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকদের নিস্তব্ধ করে ৮২ মিনিটে গোল পরিশোধ করলেন নানিঙ্গা। স্টেডিয়ামে তখন পিনপতন নীরবতা, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ালেন কেম্পেস।
১০৫ মিনিটে আবারো গ্যালারিতে গর্জন, দারুণ এক গোলে পুনরায় আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিলেন কেম্পেস। পরে বার্তনির আরো এক গোলের সুবাদে ৩-১ গোলে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতে আর্জেন্টিনা। ছয় গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি সেবারের বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন তিনি।
১৯৮২ সালে ভ্যালেন্সিয়া ছেড়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে আসেন তিনি, যোগ দেন রিভারপ্লেটে। তাদের হয়ে দুই মৌসুমে ২৯ ম্যাচে করেন ১৫ গোল। ছিলেন আর্জেন্টিনার ১৯৮২ বিশ্বকাপগামী দলেও, কিন্তু বলার মতো কিছু করতে পারেননি সেবার। জাতীয় দলের হয়ে ৪৩ ম্যাচে ২০ গোল করেন তিনি। ৮২’ বিশ্বকাপের পর থেকেই মূলত তার ক্যারিয়ার শেষের পথে চলে আসে। ইউরোপের ছোট ছোট লিগে খেলার পর ১৯৯০ সালে তিনি অবসর নেন।
আর্জেন্টিনার কথা বললেই প্রথমে মাথায় আসে ম্যারাডোনার কথা, বুয়েন্স আয়ার্সের ঈশ্বর। তারপরে নাম আসে মেসি, রিকুয়েলমে, বাতিস্ততাদের। কিন্তু আড়ালেই থেকে যান আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ের এই নায়ক। অথচ বিশ্বকাপ জয়ের পথটা ম্যারাডোনাদের দেখিয়েছিলেন কেম্পেসই।