স্কুল ক্রিকেট থেকে বিশ্বকাপ; খড়গপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট চেকার থেকে ওয়াংখেড়ে’র নায়ক; যিনি মাঠে নামলেই গ্যালারি থেকে দর্শকের চিৎকার শোনা যায়। স্বপ্নকে বাস্তবের মাটিতে নিয়ে এসেছেন যে কিংবদন্তী, তিনিই হলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। শূণ্য থেকে শুরু করেছিলেন তাঁর ক্রিকেট জীবন। মাহি থেকে হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম বড় নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি।
একটি দলে একজন অধিনায়কের ভূমিকা কি শুধু দলকে নেতৃত্ব দেওয়া কিংবা খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? না, এর বাইরেও একজন অধিনায়কের দায়িত্ব থাকে তার দল এবং তার দলের খেলোয়ারদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কঠিন পরিস্থিতিতেও হাল না ছেড়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেওয়া।
তবেই তো তিনি নায়ক। তবেই তো তিনি অধিনায়ক। অধিনায়কত্বও যে একটি শিল্প হতে পারে তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন রিকি পন্টিং আর সেটিকে পূর্ণতা দিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতের পোশাক গায়ে জড়িয়ে যেমন অর্জন করেছেন অগুনিত তেমনি চেন্নাইয়ের হলুদ জার্সিতে অধিনায়কত্ব করেও জিতেছেন, জিতিয়েছেন বহুবার।
তবে আজ ওয়াংখেড়ের নায়ক কিংবা আন্তজার্তিক ক্রিকেটের ধোনি নয়; কথা হবে চেন্নাইয়ের ঘরের ছেলে বনে যাওয়া মাহি’কে নিয়ে। আইপিএলের শুরুর মৌসুমেই সর্ব্বোচ্চ দামে চেন্নাই যাকে কিনে নিয়েছিল। ম্যানেজম্যান্টের ভরসার প্রতিদান দিতে একটুও ভুল হয়নি ধোনির। শুরু থেকেই তিনি সামনে দাঁড়িয়ে চেন্নাই শিবিরের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
প্রথম মৌসুমেই ফাইনালে উঠলেও শিরোপা জেতা হয়নি, রানার আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে ২০১০ সালে আইপিএলের তৃতীয় মৌসুমে চেন্নাইকে প্রথমবারের মত শিরোপা’র স্বাদ পাইয়ে দেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এর পরের বছর আবারো শিরোপা ধরে রাখার মিশনে উতরে যায় ধোনির নেতৃত্বাধীন চেন্নাই।
সব মিলিয়ে আইপিএলের ইতিহাসে সর্ব্বোচ্চ নয়বার ফাইনালে খেলেছিল চেন্নাই তবে ট্রফি জয়ের হিসেবে তারা রয়েছে দুই নাম্বারে। ২০১০ এবং ২০১১ এর পরে ২০১৮ এবং ২০২১ এ এসে আরো দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো ধোনি-বাহিনী।ফিক্সিং কান্ডে চেন্নাই দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলে পুনে সুপারজায়ান্টসের হয়ে আইপিএল খেলেছিলেন মাহি, যদিও অর্জনের খাতায় সেসময় যোগ করা হয়নি তেমন কিছুই। এরপর আবারো ফিরেছেন পুরনো ঠিকানায়।
আইপিএলে সর্বমোট ১৯৩ ইনিংস ব্যাট করতে নেমে প্রায় চল্লিশ গড়ে ৪৭৪৬ রান করেছেন ধোনি; স্ট্রাইক রেট ১৩৬ এর কাছেই। আইপিএল ক্যারিয়ারে ধোনি কখনো শতকের দেখা না পেলেও ২৩ বার পেয়েছেন অর্ধশতকের দেখা। ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় মিডল অর্ডারে ব্যাট করে আসা এই উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান অবিশ্বাস্য সব উপায়ে ম্যাচ শেষ করে আসতেন প্রায়শই। মিঃফিনিশার ডাকনাম তো এমনিতেই পেয়ে যাননি।
একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে এই টুর্নামেন্টে ম্যাচ জয়ের সেঞ্চুরি করার দুর্দান্ত এক কীর্তি রয়েছে ধোনির পকেটে। শিরোপা সংখ্যা মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের চেয়ে কম হলেও একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে ম্যাচ জয়ের সংখ্যা ইতোমধ্যে তিন অঙ্কে পৌঁছেছে।
এছাড়াও একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে পরপর দুইবার আইপিএলের শিরোপা ঘরে নেয়ার রেকর্ডও নিজের করে রেখেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আর কোন অধিনায়ক কিংবা ফ্রাঞ্চাইজি পারেনি শিরোপা ধরে রাখতে। চেন্নাইয়ের হয়ে ২১৩ ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে ১৩০ ম্যাচ জিতেছেন তিনি; চারটি আইপিএল ট্রফিসহ মোট ছয়টি শিরোপা নিজের করে নিয়েছেন।
ফিনিশার ধোনি একার হাতে ভারত ও চেন্নাই সুপার কিংসকে জিতিয়েছেন কত কত ম্যাচ। সেই তিনিই আইপিএলের সবকটি ম্যাচ মিলিয়ে শুধুমাত্র ২০তম ওভারগুলোতে মোট ৫৬৪ রান করেছেন। একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে আইপিএল-র বিশতম ওভারে পাঁচশো ও তাঁর বেশি রান করার রেকর্ড রয়েছে এমএসের ঝুলিতে।
উইকেটরক্ষক ধোনি’র কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায় ধোনি’র গল্প। গ্লাভস হাতে অতিমানব হয়ে ওঠা ধোনি আইপিএলেও গড়েছেন রেকর্ড। ৯৪টি ক্যাচ ও ৩৮টি স্ট্যাম্প সহ উইকেটরক্ষক হিসেবে মোট ১৩২ বার ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফিরিয়েছেন তিনি। সর্ব্বোচ্চ ডিসমিসালকারীর তালিকায় সবার উপরের নামটা তাই ‘মহেন্দ্র সিং ধোনি’।
রিকি পন্টিং এর অধিনায়কত্ব অথবা মাইকেল বেভানের এর মতো ফিনিশিং দক্ষতা কিংবা উইকেটের পেছনে মার্ক বাউচারের মতো উইকেট রক্ষা করার ক্ষমতা- সৃষ্টিকর্তা এই তিনটি গুণের সমন্বয় করেই যেন তৈরি করেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। আর তাই তো কখনো অধিনায়কত্ব দিয়ে, কখনো উইকেটের পেছনে থেকে আবার কখনো ব্যাট হাতে চেন্নাই সুপার কিংস-কে তিনি নিজের সেরাটাই দিয়েছেন।
সময় যখন প্রতিপক্ষ, মহাবীরও তখন পরাস্ত। তাই এত এত কীর্তি গড়েও সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে পেরে উঠেননি এমএস। আন্তজার্তিক ক্রিকেট-কে তো একটা টুইটেই বিদায় বলে দিয়েছেন; আইপিএল-কে বিদায় বলারও দ্বারপ্রান্তেই। চেন্নাইয়ের নতুন কান্ডারি ঠিক করার মধ্য দিয়েই ধোনি তার উপসংহারে পৌঁছলেন। হয়তো আর আর একটা আইপিএল। এরপর আর হয়তো সাত নাম্বার জার্সি পরে কেউ এতটা উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারবে না। আর কেউ হয়তো গ্লাভস হাতে বিদুৎ সৃষ্টি করতে পারবে না।
এখন পালা পরবর্তী কাণ্ডারি-কে হাল ধরার জন্য প্রস্তুত করা। তার জন্যই তো ব্যাট-প্যাড রেখে দেয়ার আগেই অধিনায়কত্বের দায়িত্ব তুলে দিলেন স্যার রবীন্দ্র জাদেজার হাতে। দায়িত্ব তুলে দেয়ার পাশাপাশি হয়তো এখন শেখাবেন অধিনায়কত্বের পাঠ। জাদেজা নিশ্চয়ই ব্যাট,বলের সাথে সাথে এবার অধিনায়কত্বের বিদ্যাও চর্চা করে নিবেন, মাঠেই তো থাকবে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা একজন কাপ্তান, একজন মহেন্দ্র সিং ধোনি।