দুনিয়া কাঁপানো এক সেশন

নাটকীয় জয়, নাটকের চেয়েও নাটকীয় জয়!

৩১ মে ২০১১ সালের সকালে পত্রিকার খেলার পাতায় বড় করে লেখা হেডলাইন গুলো ছিলো এমন; কারণ আগের দিন রাতেই কার্ডিফে লিখা হয় শ্রীলঙ্কাকে বধের নাটকীয় এক গল্প।

প্রথম ইনিংসে লংকানদের করা ৪০০ রান টপকে চতুর্থ দিনশেষে প্রথম ইনিংসে ইংলিশরা এগিয়ে ছিলো ৯৬ রানে। বৃষ্টি বাধায় ম্যাচের চারদিন পেরোলেও শেষ হয়নি প্রথম ইনিংসে খেলা। শুরু হলো ইংল্যান্ড বনাম শ্রীলঙ্কার প্রথম টেস্টের শেষ দিনের খেলা। বিগত চারদিনের মতোই সেদিনও কার্ডিফের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। যেকোনো সময় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। ম্যাচের শেষ দিন হলেও সেটি অনেকটাই ছিলো নিছক আনুষ্ঠানিকতার দিন! এক তো সেদিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসেও রয়েছে বৃষ্টির সম্ভাবনা তার মধ্যে এখনো ইংল্যান্ড তাদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করছে, কার্ডিফ টেস্টে ড্র ছাড়া অন্য কিছু কল্পনাতেও কেউ হয়তো চিন্তা করেনি।

আর সেখান থেকেই ইংল্যান্ড পেলো ভুবন কাঁপানো এক জয়। আসুন ফিরে দেখি।

সোফিয়া গার্ডেনে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন লংকান অধিনায়ক দিলশান। প্রথম সেশন পুরোটাই ভেস্তে যায় বৃষ্টিতে, প্রথম দিনে বৃষ্টি বাধায় মোটে খেলা হয় ৪৮ ওভার! ২ উইকেটে ১৩৩ রান সংগ্রহ করে সফরকারী শ্রীলঙ্কা। ২য় দিনে অবশ্য কার্ডিফে ঝামেলা করেনি বৃষ্টি, এদিন খেলা হয় পুরো ৯০ ওভারই। লংকান দুই ওপেনার দিলশান ও পারানাভিতানার অর্ধশতকের পর প্রসন্ন জয়বর্ধনে ও থিলান সামারাভিরার অর্ধশতকে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রানে অলআউট হয় লংকানরা।

দ্বিতীয় দিনের শেষ ভাগে ২০ ওভারে ১ উইকেটে ৪৭ রান সংগ্রহ করে স্বাগতিকরা। ১ম ইনিংসে ৩৫২ রানে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় দিন শুরু করে ইংলিশরা। বৃষ্টি আর আলোক স্বল্পতায় ভেস্তে যায় প্রথম সেশনের খেলা। লাঞ্চের বেশ কিছু সময় পরে খেলা শুরু হলে এলাস্টার কুক ও জনাথন ট্রটের শতকে ২ উইকেটে ২৮৭ রান নিয়ে শক্ত অবস্থানে থেকে তৃতীয় দিনে শেষ করে ইংলিশরা। প্রথম ইনিংসে লংকানদের থেকে মাত্র ১১৩ রান দূরে ইংলিশরা। চতুর্থ দিনে বৃষ্টি আর মাঠ ভেজা থাকায় লাঞ্চের পরের এক ঘন্টা পর্যন্ত মাঠে গড়ায়নি খেলা!

কার্ডিফ টেস্টে ফলাফল তখনি অনেকটাই নিশ্চিত যে এই টেস্ট ড্র হয়ে যাচ্ছে। ৪র্থ দিনে টি ব্রেকের আগে পুনরায় খেলা শুরু হয়, সেদিন আর বৃষ্টি বাধা না আসায় খেলা হয় ৬৭ ওভার। কুক শতক গড়ে আউট হলেও জনাথন ট্রট তুলে নেন দ্বিশতক! ট্রট ফিরলেও ইয়ান বেলের অপরাজিত ৯৮ রানে ৪র্থ দিনশেষে ইংলিশরা সংগ্রহ করে ৫ উইকেটে ৪৯১ রান।

খেলা বাকি একদিন, ইংল্যান্ড এগিয়ে মাত্র ৯১ রানে! শেষদিনেও সম্ভাবনা বৃষ্টির সবমিলিয়ে কার্ডিফ টেস্টে জয় পেতে যাচ্ছে বৃষ্টি এমন অবস্থা নিয়েই নাটকীয় শেষ দিনে ব্যাটিংয়ে নামে স্বাগতিক ইংলিশরা। বরাবরের মতোই শেষ দিনের প্রথম সেশনও বৃষ্টির হাসিতে পরিত্যক্ত! কিন্ত কার্ডিফের ইতিহাসে সেদিন যে এক রুপকথার গল্প লিখবার পালা, বৃষ্টির বাগড়া পাশ কাটিয়ে প্রায় দিনের অর্ধেক সময় পর শুরু হয় সেই নাটকের সূচনা। ব্যাটিংয়ে নেমে ইয়ান বেলের শতক করার পর পরই ৫ উইকেটে ৪৯৬ রানে ইনিংস ঘোষণা করে স্বাগতিকরা।

২য় ইনিংসে লংকানরা পিছিয়ে মাত্র ৯৬ রানে! তাও আবার শেষ দিনের শেষ ভাগের খেলা। চা-বিরতির বাকি ৫০ মিনিট। বৃষ্টি বাগড়া না দিলে কিংবা আলোক স্বল্পতা না হলে খেলা হবে সর্বোচ্চ ৫১ ওভার।

এখান থেকেই শুরু হলো ভয়াবহ, নাটকীয় এক ধ্বস।

দ্বিতীয় ওভারেই পারানাভিতানাকে শূন্য রানে ফেরান ট্রিমলেট, নিজের পরের ওভারে ফেরান আরেক ওপেনার দিলশানকে! মাত্র ১০ রানে ২ উইকেট নিয়ে খেলায় রোমাঞ্চকর অবস্থা করেন ট্রিমলেট। চা বিরতি পর্যন্ত ১২ ওভারে ২ উইকেট ৩৩ রান সংগ্রহ করে লংকানরা। ক্রিজে তখন লংকান ক্রিকেটের সেরা দুই স্তম্ভ কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়বর্ধনে। ফলে তখনও অনুমান করা যায়নি, কী হতে যাচ্ছে।

কার্ডিফের পাশেই ওয়েম্বলি চলছিলো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল খেলা। কমেন্ট্রিতেও বেশ কিছু সময়ে কথা হচ্ছিলো প্রিমিয়ার লিগ নিয়েই! শেষ সেশনে ইংলিশদের দরকার ৮ উইকেট, অপরদিকে ২য় ইনিংসে ৬৩ রান পিছিয়ে আছে লংকানরা! কার্ডিফ টেস্ট শেষ হয়ে বাকি তখনও ৩৯ ওভার। চা-বিরতির পর রুপকথার বাকি গল্পটা নিজেদের মতো করেই সাজালেন ট্রিমলেট-সোয়ানরা। চা-বিরতির পর প্রথম ওভারের ৫ম বলেই জয়বর্ধনকে তুলে নিয়ে নিজের ৩য় শিকার বানান ট্রিমলেট। এরপর লংকান শিবিরে আঘাত হানেন গ্রায়েম সোয়ান।

সোয়ান-ট্রিমলেট আর ব্রডের আঘাতে চা-বিরতির পর মাত্র ৭৬ বল খেলতে বিধ্বস্থ পুরো লংকান শিবির!

লংকানরা খুব করে চাচ্ছিলো আবারো মাঠে নামুক মুষলধারে বৃষ্টি! কিন্ত সেদিন কার্ডিফে শেষ সেশনে বৃষ্টি হয়েছিলো শুধু উইকেটের। প্রথম ৮ উইকেটের ৪টি করে শিকার করেন ট্রিমলেট ও সোয়ান, এছাড়া শেষ ২ উইকেট নেন আরেক পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড। শেষ ভাগে ৫১ ওভারের খেলার কথা থাকলেও লংকানরা মাত্র ২৪.৪ ওভারে ৮২ গুড়িয়ে যায় লংকানরা । মাহেলা, সাঙ্গাকারা, সামারাভিরাদের হারিয়ে সেদিন কার্ডিফের ইতিহাসে ট্রিমলেট-সোয়ানরা এক নাটকীয় ইতিহাসের জন্ম দেন।

মাত্র ৪৯ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে সেদিন কার্ডিফে লজ্জার মুখে পড়েছিলো সাঙ্গকারা-জয়বর্ধনরা। ইংলিশরা জয় পায় এক ইনিংস ও ১৪ রানে। লংকানরা শেষ দিনে ব্যাট করবার আগে সাড়ে ৪ দিনে মোটে খেলা হয়েছিলো ২৭৩.৪ ওভার! যা কিনা ৩ দিনের খেলা। বৃষ্টির বাধা, প্রসন্ন জয়বর্ধনের শতক কিছুই হার মানাতে পারেনি সেদিন ট্রিমলেট-সোয়ানদের।

সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ শেষে ব্রড তার ভেরিফাইড টুইটার একাউন্টে লিখেনঃ “That’s the most unbelievable Test win I’ve played in! Sat in the changing room for 3 days and sneaked a win!” Well, quite.

আর কিছু না হোক ইংলিশরা নিশ্চয়ই খানিক সময়ের জন্য ওয়েম্বলির ফুটবল ম্যাচের চেয়ে বেশী আকর্ষন খুজে পেয়েছিলো টেস্টের এই এক সেশনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link