চার উইকেটরক্ষকের এক টেস্ট!

ক্রিকেটের তীর্থ খ্যাত লর্ডসে এখন অবধি অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৩০ টেস্ট। নানা ঘটনা, অতিমানবীয় পারফরমেন্সের সাক্ষী এই মাঠ। ১৯৮৬ সালে নিউজিল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের মধ্যকার আপাতনিরীহ ড্র টেস্টের কথা তাই সবার ভুলে যাবারই কথা। কিন্তু সেই টেস্ট স্মরণীয় হয়ে আছে এক ঘটনায়। সেই টেস্টে এক ম্যাচেই চার উইকেটরক্ষক খেলিয়েছিল ইংলিশরা।

লর্ডসে রৌদ্রজ্জ্বল এক সকালে টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন ইংরেজ অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং। মার্টিন মক্সন এবং ডেভিড গাওয়ারের ফিফটির সুবাদে বড় সংগ্রহের দিকে ভালোভাবেই আগাচ্ছিল ইংল্যান্ড। বিপত্তিটা ঘটে ২৫৮ রানে মাথায়, ফিল এডমন্ড স্লিপে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরে গেলে উইকেটে আসেন কিপার ব্রুস ফ্রেঞ্চ। বল হাতে তখন অন্যপ্রান্তে আগুন ঝড়াচ্ছেন রিচার্ড হ্যাডলি।

কোনোমতে ১১ টি বল কাটিয়ে দিয়ে যখন সবাই ভেবেছিল থিতু হয়েছেন ফ্রেঞ্চ, তখন ঘটে যায় অঘটন। হ্যাডলির আগুনে গতির এক বাউন্সার এসে লাগে ফ্রেঞ্চের হেলমেটের পেছনের অংশে। অনাবৃত অংশে লাগায় উইকেটেই লুটিয়ে পড়েন ফ্রেঞ্চ। তাকে সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়া হয়, তিনটি সেলাইয়ের প্রয়োজন হয় তাঁর।

ব্রুস ফ্রেঞ্চ

সেদিন হ্যাডলি নেন ছয় উইকেট এবং ইংল্যান্ড অলআউট হয় ৩০৭ রানে। বল হাতে হ্যাডলি সেদিন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। উইজডেন পরবর্তীতে ঘটনার ব্যাখা দিয়েছিল এভাবে, ‘ম্যাচে একই সাথে দুইটি খেলা হচ্ছিল। এক যখন হ্যাডলি বল করছিলেন এবং দুই যখন তিনি বল করছিলেন না।’

নিউজিল্যান্ড যখন ব্যাটিংয়ে নামে স্বাভাবিকভাবেই ফ্রেঞ্চ তখন উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় ছিলেন না। এমনকি পুরো ম্যাচে আর নামতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েই সন্দিহান ছিলেন সবাই। নিরুপায় হয়ে একাদশে বিল অ্যাথিকেই উইকেটরক্ষক হিসেবে নামায় ইংল্যান্ড। কিন্তু তিনি উইকেটের পেছনে ছিলেন কেবল মাত্র দুই ওভার।

বব টেইলর ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন বছর খানেক। ৪৫ বছর বয়সের টেইলর উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর চাইতে তখন সোফায় বসে ক্রিকেট দেখতেই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু ইংল্যান্ডের এই দুরবস্থায় আরো একবার গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়ালেন তিনি।

বব টেলর

নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা বরাবরই মাঠে জয়ের চাইতে ক্রিকেটীয় চেতনা বজায় থাকার দিকে বেশি মনোযোগী হন। জয় পাবার চাইতে জয়টা কিভাবে এলো সেটা তাদের জন্য বেশি জরুরি। মাইক গ্যাটিং যখন তাই কিউই অধিনায়ক জেরেমি কোনিকে অনুরোধ করলেন স্কোয়াডের বাইরে থাকা টেইলরকে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে দেবার জন্য বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে অনুমতি দিয়ে দেন তিনি।

তখন বাঁধে আরেক বিপত্তি, ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার দরুণ টেইলরের কাছে ছিল না কোনো গ্লাভস। পরে এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা গ্লাভস নিয়ে মাঠে নামেন তিনি।

স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘদিন ক্রিকেটের বাইরে থাকা টেইলর গ্লাভস হাতে ঝলক দেখাতে পারেননি। বেশ কয়েকবার বল ছেড়েছেন। কোনো স্ট্যাম্পিং করা দূরে থাক, কোনো ক্যাচও নিতে পারেননি। ফলে অচিরেই আরো একবার পরিবর্তিত হয় ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষক পজিশন, এবার গ্লাভস হাতে মাঠে নামেন ববি পার্কস।

বব টেলরকে প্যাড পরতে সাহায্য করছেন বিল অ্যাথি।

অন্যদিকে, মার্টিন ক্রোর সেঞ্চুরির পাশাপাশি ব্রুস এডগার এবং অধিনায়ক কোনির ফিফটিতে প্রথম ইনিংসে ৩৫ রানের লিড নেয় কিউইরা। অন্যদিকে, উইকেটরক্ষকের ঝামেলা থেকে রক্ষা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন ইংরেজ অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং।

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে গ্রাহাম গুচের অনবদ্য ১৮৩ রানের সুবাদে ছয় উইকেটে ২৯৫ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড। চতুর্থ দিনে চিকিৎসকরা জানান পুনরায় মাঠে নামতে পারবেন ফ্রেঞ্চ। এ খবর শুনে জয়ের লক্ষ্যে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন ইংরেজ অধিনায়ক। উইকেটের পেছনে প্রথমবারের মতো দাঁড়ান ফ্রেঞ্চ।

ফলে ম্যাচটি জায়গা করে নেয় ইতিহাসে, এক ম্যাচে চার উইকেটরক্ষক খেলানোর বিরল এক রেকর্ডে। গ্রাহাম ডিলি এবং নেইল ফস্টার শূন্য রানে দুই কিউই ওপেনারকে ফিরিয়ে দিলে জয়ের সম্ভাবনা জেগেছিল ইংরেজ শিবিরে। কিন্তু সে সম্ভাবনায় জল ঢেলে দেন কেন রুদারফোর্ড এবং মার্টিন ক্রো।

ববি পার্কস

দায়িত্বশীল ব্যাটিং করে কোনো অঘটন দেননি এই দুজন। ফলশ্রুতিতে ড্র হয় ম্যাচটি। আপাতদৃষ্টিতে ম্যাড়মেড়ে ড্র মনে হলেও ম্যাচটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে এক ম্যাচে চার উইকেটরক্ষক খেলানোর কারণে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link