গোলের অংক কিংবা অংকের গোল

মুক্ত আকাশ পানে একটা ধাতব কয়েন টস করলে হেড হওয়ার সম্ভাব্যতা কতটুকু? কিংবা লুডুর এক চালে ২ আসার সম্ভাবনা কতটুকু? ছোট বেলা কিংবা বড়বেলা এমন অঙ্কের সাথে পরিচিতি হন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। অঙ্কের দুনিয়ার এ জট পাকানো সমস্যার সমাধানে আবার অনেকে বিচরণও করেন।

মুক্ত আকাশ পানে একটা ধাতব কয়েন টস করলে হেড হওয়ার সম্ভাব্যতা কতটুকু? কিংবা লুডুর এক চালে ২ আসার সম্ভাবনা কতটুকু? ছোট বেলা কিংবা বড়বেলা এমন অঙ্কের সাথে পরিচিতি হন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। অঙ্কের দুনিয়ার এ জট পাকানো সমস্যার সমাধানে আবার অনেকে বিচরণও করেন।

তা অঙ্কের এ জনপ্রিয় মেথডের উৎপত্তিটা কিভাবে হয়েছিল? সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে জুয়া খেলার খুব প্রচলন ছিল। সে সময়ে জুয়া খেলা এক প্রকার আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো ফরাসি সমাজে। তো তখনকার সময়ে এক বিখ্যাত জুয়াড়ি শ্যাভেলিয়ার ডি মেরে একদিন চিন্তা করলেন কিভাবে খেললে জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে?

শ্যাভেলিয়ার আবার বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাসকেল। এজন্য তিনি তার বন্ধু প্যাসকেল কে অনুরোধ করলেন বিষয়টির সমাধান করার জন্য। প্যাসকেলের কাছেও বিষয়টি বেশ আকর্ষণীয় মনে হলো। প্যাসকেল তখন তার আরেক গণিতবিদ বন্ধু পিয়ের দ্য ফার্মার সাথে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করেন। এরপর চলতে থাকে দুই জনের নিরন্তর চিন্তা। আর এভাবেই জন্ম নেয় প্রবাবিলিটি বা সম্ভাব্যতা।

যাহোক, গাণিতিক ইতিহাস কপচানো অনেক হলো। মূলত প্রবাবিলিটি নিয়ে এমন লম্বা প্রারম্ভিকা করার কারণ হলো, ফুটবলেও এমন সম্ভাব্যতা যাচাইকরণের একটা মডেল আছে। যার নাম এক্সজি (এক্সপেকটেড গোলস)। একজন ফুটবলারের একটি শটে গোল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা যাচাইকরণের জন্য এই মডেল টা ব্যবহার করা হয়। আর এর জন্য মূলত ৪ টি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা হয়।

  • বল শ্যুটারের অবস্থান

গোলপোস্ট থেকে বল শ্যুটারের অবস্থান কত দূরে ছিল এবং গোল লাইন থেকে কত ডিগ্রি কোণে ছিল।

  • শরীরে অংশ

শরীরের কোন অংশ থেকে বল গোলমুখী হয়েছে, মাথা নাকি পা- তা এর মাধ্যমে দেখা হয়।

  • পাসের ধরণ

পাসটা কেমন ছিল? থ্রোয়িং বল, ক্রস নাকি সেট পিস থেকে- তা দেখা হয়।

  • আক্রমণের ধরণ

আক্রমণটা কেমন ছিল? শুরু থেকেই কি আক্রমণটা গোছানো ছিল, বল রিবাউন্ড করে আনা কিনা, আক্রমণের সময় ডিফেন্সের পজিশন ছিল কেমন, আক্রমণটা ড্রিবলিংয়ের মাধ্যমে হয়েছে কিনা- এ বিষয়গুলা খুবই সুক্ষ্মভাবে দেখা হয়।

এখন কথা হলো, এগুলো নির্ণয় করার পরের ধাপটা কি? শুধু এ গুলো নির্ণয় করেই তো আর গোলের প্রবাবিলিটি নির্ণয় করা সম্ভব না। মূলত অন টার্গেটে শট মারা পুরো প্রসেসটা বিবেচনা করে ঐ একই রকম ১০০০ টি ঘটনার সাথে তুলনা করে একটি গোলের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। আর এই পুরো মাধ্যমটা খুবই নিখুঁতভাবে করা হয়।

এই হিসেবে এক্সজি এর মান ১ হওয়া মানে নিশ্চিত গোল, এক্সজি এর মান ০ হওয়া মানে নিশ্চিত গোল মিস, এক্সজি এর মান ০.৫ হওয়া মানে ১০ টি শটের মধ্যে ৫ টিতেই গোল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এক্সজি এর ব্যবহার একটা দল বা ফুটবলারের জন্য কতটা উপকারী।

  • একজন ফুটবলারের গোলসংখ্যা আর এক্সজি নাম্বারের ব্যবধান তার বল শ্যুটিং সক্ষমতা কতটা ফলপ্রসু তা নির্ধারণ করে। কোনো স্ট্রাইকারের গোলসংখ্যা যদি এক্সজি এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে তার এবোভ এভারেজ ফিনিশিং ক্ষমতা রয়েছে।
  • এক্সজি এর সাথে আরেকটা টার্ম আছে যেটার নাম এক্সজিএ (এক্সপেকটেড গোল অ্যালাউড). একটা দল প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে কতটা গোল হজম করা থেকে নিজেদের প্রতিরোধ করতে পারে তা নির্ধারণ করে এক্সজিএ। আর এক্সজি এবং এক্সজি এর বিয়োগফলকে বলা হয় এক্সজিডি (এক্সপেকটেড গোল ডিফারেন্স)। একটা দলের সামগ্রিক পারফরমেন্স মূল্যায়ন করতে এই এক্সজিডি বেশ প্রয়োজনীয়। এক্সজিডি যদি মাইনাস হয় তাহলে ধরে নিতে হবে ঐ দলের স্ট্রাইকারদের ফিনিশিং দুর্বলতা আছে। একই সাথে দলের ডিফেন্ডারদেরও এভাবে মূল্যায়ন করা যায়।

এক্সজি থিওরিটা আরেকটু পরিষ্কার হবে যদি একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

ধরা যাক, নেইমার আর এমবাপ্পে, দুজনেই ১০০ টি করে অন টার্গেটে শট খেলেছেন। এর মধ্যে নেইমার গোল করেছেন ১৪ টি, এমবাপ্পে করেছেন ৮ টি। এখন তাদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? প্রথম পার্থক্য তো গোলের ব্যবধান তা বুঝাই যাচ্ছে। কিন্তু আরেকটা পার্থক্য হলো তাদের গোলের ধরনে।

এখন একপেক্টেড গোলের মেট্রিক্সে ধরা যাক, এই ১০০ টি শটে নেইমারের এক্সজি ০.১৮ আর এমবাপ্পের ০.৭। এর অর্থ হলো, নেইমারের গোল করার ক্ষেত্রে গড় বিবেচনায় ১৮ টি গোল আশা করা যায়। আর এমবাপ্পের কাছ থেকে ৭ টি গোল আশা করা যায়। অর্থাৎ গোল বেশি হলেও গোল করার ধরন, প্রচেষ্টাসহ আরো কিছু প্যারামিটার নিয়ে এক্সপেক্টেড গোল নির্ণয় করা হয়।

এবার আসি পেনাল্টি নিয়ে। পেনাল্টি শট তো সবসময় একই দূরত্ব থেকে করা হয়। তাহলে এর এক্সজি কত? পেনাল্টির এক্সজি হলো ০.৭৬। এই একই হিসাব দিয়ে গোলরক্ষকেরও পেনাল্টি সেভের সক্ষমতা নির্ণয় করা যায়। পেনাল্টির কথা যখন আসলো, তখন জানিয়ে রাখা ভাল, এই মডেলে নন পেনাল্টি এক্সপেক্টেড গোল নামক একটা টার্ম আছে। যেটাকে সংক্ষেপে বলে এনপিএক্সজি। মূলত এটা টোটাল এক্সপেক্টেড গোলের সাথে এক্সপেক্টেড পেনাল্টি গোল বিয়োগ করে বের করা হয়।

এক্সপেক্টেড গোলের মতো এক্সপেক্টেড এসিস্টও আছে যাকে এক্সএ বলে। এটা মূলত প্রাথমিকভাবে একটা বলের পাসকে নির্দেশ করে। ঐ পাসটা কোন জায়গা থেকে এসেছিল, গোলপোস্ট থেকে কতটুকু এরিয়ার মধ্যে ছিল- এসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে এক্সএ নির্ধারণ করা হয়। যদিও এটা খুব একটা বেশি ব্যবহার করা হয় না। কারণ এটা নির্ণয়ে জটিলতাসহ সঠিক সম্ভাবনা নির্ণয়ে কিছুটা আশঙ্কা থাকে।

এই ছিল ফুটবলের একপেক্টেড গোল থিওরির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। বর্তমানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এক্সজি মডেল নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ইউরোপিয়ান ফুটবল ক্লাব গুলোর এনালিস্টরাও প্রি-ম্যাচ এনালাইসিসে এই প্যারামিটারের সাহায্য নিচ্ছেন। আর বিভিন্ন চ্যানেলের পোস্ট ম্যাচ এনালাইসিসে তো ইতোমধ্যেই ‘টক অব দ্য শো’ হয়ে উঠেছে এই এক্সজি মডেলের বিভিন্ন স্ট্যাটস। আগামীতে বিভিন্ন দলের শক্তিমত্তার জায়গা, দুর্বলতাসহ আরো অনেক বিশ্লেষণ সহজ করে দেওয়ার জন্য এক্সপেক্টেড গোলস টার্মিনোলজি যে দারুণভাবে কাজ করবে তা দ্বিধাহীনভাবে বলাই যায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...