২০১৬ সালের কথা।
খেলার ক্যারিয়ার তাঁর তখন কার্যত শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখার বয়স নেই। তারপরও সেই সময়টা খুব ছোটাছুটি করছিলেন।
সতেরো বছর বয়সী তরুণের মতো ছোটাছুটি করেছেন। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ছুটে এসে এসে ওয়াহিদুল গনির পরামর্শ নিয়ে গেছেন। সেই অনুযায়ী একা একা স্টেডিয়ামে গিয়ে অ্যাকশন শুধরানোর কাজ করেছেন, জিমে ঘাম ঝরিয়েছেন।
অবশেষে পরীক্ষা দিলেন। বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিলেন। আর পরীক্ষা দিয়েই বললেন-বিদায়!
চল্লিশ ছুঁই ছুঁই তারুণ্য ভরা চেহারা নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে দাড়িয়ে বললেন, আর ক্রিকেট খেলবেন না। হাসতে হাসতে জানালেন, সব ধরণের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছেন।
তাহলে!
তাহলে কেনো এই বোলিং অ্যাকশন নিয়ে মাতামাতি? কেনো শুদ্ধ অ্যাকশনে ফেরার চেষ্টা ? না খেললে আর অ্যাকশনের দাম কী!
হেসে বললেন, ‘খেলবো না ঠিক আছে। তাই বলে একটা বদনাম নিয়ে চলে যাব? সেটা তো ক্রিকেটকে অসম্মান করা হয়। এজন্যই ঠিক করেছিলাম, অ্যাকশন পরীক্ষা দিয়ে অবসরের ঘোষনা দেব।’
আহ! এটাই ক্রিকেট।
এই একটা কথার জন্যই তাঁকে ‘মিস্টার ক্রিকেট’ খেতাব দিয়ে দেওয়া সম্ভব। এই একটা কথাই বলে দেয়, তিনি কেবল একজন ক্রিকেটার নন; ক্রিকেটের একজন প্রতীক। যিনি শেষ লগ্নেও খেলাটাকে অসম্মান করতে রাজী নন।
এই ক্রিকেটের চেতনা তুলে ধরা মানুষটিই ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতীক হয়ে গত দুই দশক ধরে মাঠে ব্যস্ত থাকা ডিকেন্স। এই সময়ের অনেক নতুনের কাছে ডিকেন্সের নামটা একটু অপরিচিত মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের খোঁজ খবর যারা রাখেন, তারা জানেন, আক্ষরিক অর্থেই গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক অবিচ্ছেদ্য নাম ছিলেন এই ডিকেন্স।
ভবিষ্যৎ তারকা হিসেবে শুরু করেছিলেন, সম্ভাবনাময় হিসেবে জাতীয় দলেও এসেছিলেন। সেখানে পায়ের নিচে মাটিটা শক্ত করতে পারেননি। কিন্তু ডিকেন্স ছিটকে যাননি। সোনালী সময় তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু ডিকেন্স এই খেলাটায় রয়ে গেছেন। বছরের পর বছর স্কোরকার্ডে তার নাম দেখতে দেখতে মনে হত, ডিকেন্সকে ছাড়া বুঝি ঘরোয়া ক্রিকেট আয়োজন হবে না কখনো!
আজ থেকে ২৫ বছর আগে, ১৯৯১ সালে নিজের জেলা কুমিল্লায় বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
বাবা তোফাজ্জল হোসেন এক সময় ঢাকার হকির বেশ নামকরা খেলোয়াড় ছিলেন। খেলেছেন হকির পাওয়ার হাউস আজাদ স্পোর্টিং, মেরিনার্স, রেলওয়ের মত দলে। ঢাকায় ফুটবলও খেলেছেন ডিকেন্সের বাবা।
কাকরাইল স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে খেলা শুরু করেন ডিকেন্স ১৯৯৬ সালে। দু বছর পর, আজাদ স্পোর্টিংয়ের হয়েই প্রিমিয়ারে অভিষেক। আর বাংলাদেশে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট চালুর পরের বছর, ২০০০ সালে চট্টগ্রামের হয়ে শুরু হয় প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলা।
মানে সোজাসুজি গত ২০ বছর ধরে ঢাকার ক্রিকেটে খেলছেন, খেলছেন ১৫ বছর ধরে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট। এই দীর্ঘ পথচলায় আবাহনী, মোহামেডান থেকে শুরু করে দেশের সব শীর্ষ ক্লাবেই খেলেছেন; মোহামেডানেই লম্বা সময় ধরে খেলেছেন। বাংলাদেশ ‘এ’ দলের অত্যন্ত নিয়মিত মুখ ছিলেন একটা সময়।
২০০৪ সালে প্রথম জাতীয় দলে ডাক পান; তখন বাংলাদেশে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বিশেষ কদর ছিলো। সে দফা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি ওয়ানডে ও কলম্বো এশিয়া কাপে তিনটি ওয়ানডে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেললেও প্রায় কিছুই করতে পারেননি। পরে ২০১০ সালে অসাধারণ দুটি ঘরোয়া ক্রিকেটের মৌসুমের ফল হিসেবে আবারও জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন।
পরপর দুই মৌসুমে দেশের প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে তার রান ছিল ৭৭৫ ও ৮৮০; গড় ছিল ৫১.৬৬ ও ৫৮.৬৬। ফল হিসেবে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে আরও দুটি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পান। এ দফাও ডিকেন্স নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। মজার ব্যাপার হল, মাত্র দুই মৌসুম আগেও দেশের প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ৫১.৮৪ গড়ে ৬৭৪ রান করেছেন।
ততোদিনে ডিকেন্স বুঝে ফেলেছেন, সবার জন্য সবকিছু নয়। জাতীয় দলে আরও সুযোগ না পাওয়া বা এক্সপোজার কম পাওয়া নিয়ে খুব একটা আফসোসও করেন না তিনি। মেনে নেন যে, এটাই নিয়তি। তিনিই সময় কাজে লাগাতে পারেননি।
এই যেমন বলছিলেন, ‘একটা স্বপ্ন ছিল, মাঠ থেকে বিদায় নেব। কিন্তু নিজেই ভুল করেছি। দুই মৌসুম আগে সিদ্ধান্তটা নিলে ভাল খেলা অবস্থায় চলে যেতে পারতাম। গত মৌসুমে যখনই ভেবেছি, পরের ম্যাচে বলে দেবো, আর দলে সুযোগ পাইনি। পরে ভাবলাম, প্রিমিয়ার লিগ থেকে বলে দেবো। ঠিক মোহামেডানের শেষ ম্যাচটায় চান্স পেলাম না। নিজেই দেরী করে ফেললাম মনে হয়। এতদিনের সম্পর্ক…’
কষ্ট হয়, ডিকেন্স। আমরা বড় জোর, আপনার কষ্টটা অনুমান করতে পারি। ২২ গজের সাথে যে সম্পর্ক গড়েছেন ২৫ বছর ধরে, তা ছেড়ার কষ্ট তো সহজ নয়। ডিকেন্সের সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, এই প্রায় আড়াই দশকের ক্যারিয়ারে কোনো একটা স্ক্যান্ডাল নেই, একটা ফিসফিসানি নেই। এমনকি চাওয়া-পাওয়াও খুব একটা নেই। কেবল সাধকের মত খেলে গেছেন। ক্যারিয়ারে চারটি মৌসুমে ৫০-এর ওপরে গড়ে রান করেছেন। তার চেয়ে বড় কথা ফিটনেস দিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছেন সবাইকে।
তার সতীর্থরা তো বটেই, জুনিয়ররাও অনেকে কোচ হয়ে গেছেন; কর্মকর্তা হয়ে গেছেন। ডিকেন্স নিজেও বছর পাঁচেক আগে কোচিং কোর্সের প্রথম লেভেল শেষ করেছিলেন। কিন্তু খেলাতেই থেকে গেছেন। শেষ দিনটা অবদি তরুণদের লজ্জা দিয়েছেন ফিটনেসে।
খেলা ছাড়ার সময়ে তাই ওই ফিটনেস ট্রেনিংয়ের বিষয়টাকেই সম্বল করতে চাইলেন, ‘কোচিং করাতে পারি। ট্রেনার হওয়ার জন্যও একটা চেষ্টা করবো। যাই করি, ক্রিকেটেই থাকবো। আর তো কিছু শিখিনি।’
ক্রিকেটেই আপনাকে মানায়, ডিকেন্স।
ক্রিকেটে মানায় বলেই শেষ দিনে বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষা দিয়ে তবে অবসরের ঘোষনা দিতে পারেন। ক্রিকেটে মানায় বলেই খেলার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে শুদ্ধতা। এই জন্যই বলেন, ‘২৫ বছরে আমি শরীরে কোনো দাগ লাগতে দেই। অবসরের পরেও যদি কেউ কোনোদিন বলে, ওর অ্যাকশন ইলিগ্যাল ছিল, আমি সহ্য করতে পারবো না। নিজের অ্যাকশন শুদ্ধ করে তবে যাব।’
বিশ্বাস করুন, ডিকেন্স এই কথা বলছেন, যখন দুনিয়ার অধিকাংশ স্পিনার মনে করেন, কনুই বাঁকানোর স্বাধীনতা তাদের দেওয়া উচিত, যখন ক্রিকেট থেকে নৈতিকতা বিদায় নিতে বসেছে। সেই সময়ে এই কথা বলছেন ডিকেন্স!
বাংলাদেশের যুব ক্রিকেটারদের সৌভাগ্য, তারা যুব দলে ফিল্ডিং কোচ হিসেবে পেয়েছেন এই ডিকেন্সকে। তার এই ফিটনেস নিয়ে পাগলামি তো আছেই। সেই সাথে ভবিষ্যতের তারকারা ডিকেন্সের কাছ থেকে ক্রিকেট প্রেমও কিছুটা শিখবেন বলে আশা করা যায়। অন্তত সততার সাথে আপোষ করতে পারবেন না ডিকেন্সের শিষ্যরা।