বিনোদ কাম্বলির গল্পটা ভারতীয় ক্রিকেটের রূপকথার অংশ। স্কুল ক্রিকেটে ছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের সমসাময়িক, ভাল বন্ধু। কারো কারো বিবেচনায় শচীনের চেয়ে কাম্বলিই বেশি প্রতিভাবান ছিলেন। তবে, কাম্বলির সেই প্রতিভা হারিয়ে গেছে পরিশ্রমের অভাবে। তিনি ক্রিকেটের অন্যতম বড় ‘কি হত যদি’র উদাহরণ।
তবে, এটা ঠিক যে – কাম্বলির ঝাঁ-চকচকে একটা ব্যাটিং স্টাইল ছিল। ক্যারিশমাটিক ব্যাটিং দিয়ে নিজের দিনে তিনি যেকোনো খেলাকেই পাল্টে দিতে পারতেন। কিন্তু, পরিস্থিতি, শৃঙ্খলার অভাব, নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা তাঁর ক্যারিয়ারকে শেষ করে দিয়েছে একেবারে।
এক গাদা সুযোগ পেয়েও তিনি বারবার ব্যর্থ হয়েছে। লম্বা দৌড়ে তিনি টিকতে পারেননি ভারতীয় দলে। এর ওপর মাঠের বাইরের নানা রকম অঘটন তো ঘটিয়েছেনই।
কাম্বলির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ‘হাইলাইটস’ হল টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর সূচনাপর্ব। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে দ্রুত সময়ে হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছেছেন। সেই রেকর্ডটা টিকে আছে আজো।
গোটা ক্রিকেট ইতিহাসেই তাঁর চেয়ে কম সময়ে এই মাইলফলকে পৌঁছেছেন আর মাত্র তিন জন। তারা হলেন – হোবার্ট সাটক্লিফ (ইংল্যান্ড – ১২ ইনিংস), স্যার এভারটন উইকস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ – ১২ ইনিংস) ও স্বয়ং স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (অস্ট্রেলিয়া – ১৩ ইনিংস)। কাম্বলির সমান ১৪ ইনিংস লেগেছিল অস্ট্রেলিয়ার রবার্ট নিল হার্ভিরও।
প্রথম আট ইনিংস শেষে কাম্বলি করেছিলেন ৭৯৩ রান, চারটি সেঞ্চুরির সুবাদে। এটা গোটা ইতিহাসেই আট ইনিংস শেষে সর্বোচ্চ রানের নজীর। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৭৪ রান করেন কাম্বলির স্বদেশি সুনীল গাভাস্কার।
নব্বইয়ের দশকে ভারত আজকের মত প্রতাপশালী সর্বজয়ী দল ছিল না। ফলে, বাঁ-হাতি কাম্বলি যখন টেস্টে এসেই মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রথম আট ইনিংসে দু’টো ডাবল সেঞ্চুরি আর দু’টো সেঞ্চুরি পেয়ে যান – তখন সেটা ছিল বিরাট ব্যাপার।
১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর অভিষেক। প্রথম টেস্টে তিনি তিন নম্বরে নেমে যথাক্রমে ১৬ আর ১৮ রান করেন। দ্বিতীয় টেস্টে করেন হাফ সেঞ্চুরি (৫৯)। তৃতীয় টেস্টে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে দেখা যায় কাম্বলির আসল চেহারা। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটাকে ডাবলে নিয়ে যান তিনি।
৫০-এর ঘরে পৌঁছানোর পর একবার জীবন পান। এর বাদে জমকালো এক ইনিংস। ২৩ টি চারের সৌজন্যে আসা সেই ২২৪ রানের ইনিংসটা মুম্বাইয়ের দর্শকরা বেশ উপভোগ করেছিল। সেই ইনিংস খেলার পর মুম্বাইয়ের আরেক ঘরের ছেলে সুনীল গাভাস্কার তাঁকে সানগ্লাস উপহার দিয়েছিলেন।
সেই সিরিজে ভারত হোয়াইটওয়াশ করে ইংল্যান্ডকে। কাম্বলি ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইংল্যান্ড দলের সিনিয়র ক্রিকেটার তখন গ্রাহাম গুচ আর মাইক গ্যাটিং, শৈশবে যাদের খেলা আমি দেখেছি। তারা এগিয়ে এসে আমার পিঠ চাপড়ে যান। সেটা আমার শিরদাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দেয়, কারণ ওরা ছিল আমার হিরো, ওদের কথা পড়েছি, ওদের দেখে শিখেছি।’
এরপর দিল্লীতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটা টেস্ট খেলে ভারত। সেখানে ২২৭ রনের ইনিংস খেলেন কাম্বলি। ৩০১ বলে খেলা সেই ইনিংসের স্ট্রাইক রেট ছিল ৭৫। সেই আমলে এই স্ট্রাইক রেট কেবল ওয়ানডেতেই মানাতো! এটা কাম্বলির টেস্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসও।
সেই সুবাদে প্রথম ভারতীয় হিসেবে টেস্টে টানা দুই ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড পেয়ে গেলেন। এই কীর্তি আছে কেবল হাতে গোনা ক’জনার। সেই তালিকায় থাকা ডন ব্র্যাডম্যান, বিরাট কোহলি, কুমার সাঙ্গাকার, ওয়ালি হ্যামন্ড আর মাইকেল ক্লার্ক – নামগুলোতেই প্রমাণিত হয় – রেকর্ডটা কতটা ওজনদার।
সেই বছরের জুলাইয়ে ভারত খেলতে যায় শ্রীলঙ্কায়। সেখানে মুম্বাইয়ের এই ব্যাটসম্যান ১২৫ আর আর ১২০ রানের দু’টি ইনিংস খেলেন। এখানেই তাঁর টেস্ট সেঞ্চুরির ইতি ঘটে।
এমনকি হাজার রানে পৌঁছানোর পর তিনি মাত্র আর তিনটি টেস্ট খেলতে পারেন। টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয় ১৯৯৫ সালে। ১৭ ম্যাচে খেলা ২১ ইনিংসে ১০৮৪ রান নিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যদিও, তাঁর ব্যাটিং গড় ৫৪.২০। কমপক্ষে ২০ ইনিংস ব্যাট করেছেন, এমন কোনো ভারতীয় আজো এই ব্যাটিং গড় ছুঁতে পারেননি। এই তালিকায় শচীন, গাভাস্কার, রাহুল দ্রাবিড়, বীরেন্দ্র শেবাগ কিংবা বিরাট কোহলির মত মহারথীরাও আছেন।
কেন সাদা পোশাকে টিকতে পারেননি কাম্বলি? শর্ট বল আর বাউন্সারে বিশেষ দুর্বলতা ছিল তাঁর। তার ওপর উপমহাদেশের বাইরে তিনি চূড়ান্ত ব্যর্থ হন। সমস্যা কাটিয়ে কাম্বলি অবশ্য ফিরতে পারতেন। শেষ টেস্ট যখন খেলেন, তখন বয়স মাত্র ২৩ বছর।
কিন্তু, ফেরার মত অধ্যবসায়ী কখনোই ছিলেন না কাম্বলি। বরং বাইশ গজের বাইরের রঙিন জীবনই বেশি টানতো তাঁকে। তাই, ভারতের জন্য তাঁর ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রতিভাকে হারানোর পথ সহজ হয়!