নক্ষত্র হতে পারেননি পাতো

অনেক ফুটবলারের শুরুটা দেখেই মনে হয়, এই ছেলেটি বিশ্বজয় করে ছাড়বে। ছোট্ট বেলাতেই তাকে নিয়ে তৈরী হয় অনেক গল্প আর প্রত্যাশা। কিন্তু সবাই এই প্রত্যাশা মিটিয়ে মেসি বা নেইমার হতে পারে না। যেমন পারেননি আলেজান্দ্রে পাতো।

সকাল সব দিনের সত্যিকারের আভাষ দিতে পারে না।

অনেক ফুটবলারের শুরুটা দেখেই মনে হয়, এই ছেলেটি বিশ্বজয় করে ছাড়বে। ছোট্ট বেলাতেই তাকে নিয়ে তৈরী হয় অনেক গল্প আর প্রত্যাশা। কিন্তু সবাই এই প্রত্যাশা মিটিয়ে মেসি বা নেইমার হতে পারে না। যেমন পারেননি আলেজান্দ্রে পাতো।

অ্যান্টেনিও ক্যাসানো থেকে রাভেল মরিসন পর্যন্ত অনেক ফুটবলারই তাদের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নিজেদের পারফর্ম দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তারা হতে পারতেন তাদের নিজেদের সময়ের কিংবদন্তী ফুটবলার কিন্তু সেটা না হয়ে তারা হয়েছেন অন্য প্রতিভাবান ফুটবলারদের জন্য এক সতর্কতার বিষয়বস্তু।

আলেজান্দ্রে পাতো ঠিক এই রকমই একজন ফুটবলার। হঠাৎই পেয়েছিলেন তারকা খ্যাতি। তারকা খ্যাতি পেয়ে এসেছিলেন ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে টিকতে পারেননি সেখানে। পরবর্তীতে পাড়ি জমান অর্থের ঝনঝানিতে পরিপূর্ণ লিগ চাইনিজ সুপার লিগে। কিন্তু সেখানেও টিকে থাকতে পারেননি পাতো।

পাতোর পতন ছিল ঠিক তাঁর উত্থানের মতই দ্রুত একটি ঘটনা। মাত্র ২১ বছর বয়সে নিজের জন্মভূমির বাল্যকালের ক্লাব ছেড়ে পাড়ি জমান ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানে। ইতালিতে এসে সাত বছর পর মিলানকে জেতান লিগ শিরোপা। তবে ইনজুরি তাঁর ক্যারিয়ারকে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্থ করছিল। আর ঠিক সেই কারণেই নিজের লক্ষ্য থেকে কিছুটা হলেও নড়ে গিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রো পাতো।

আলেজান্দ্রো পাতোর জন্ম ব্রাজিলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য পারানার শহর ব্রাঞ্চোতে। মাত্র ১১ বছরত বয়সেই জীবন হারানোর শঙ্কায় ছিলেন তিনি। তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু আগেই হাতে হওয়া এক টিউমারের কারনে হাত হারাতে বসেছিলেন তিনি। কিন্তু চিকিৎসকদের চেষ্টায় সেই যাত্রা থেকে বেঁচে যান তিনি।

সুস্থ হবার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সুযোগ পেয়ে যান ন্যাসিওন্যালের যুব দলে। ন্যাসিওন্যাল ফুটবল ক্লাবের যুব প্রজেক্টের মাধ্যমে উঠে আসেন আলেকজান্দ্রো পাতো। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে যান ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-২০ দলে। যেখানে তিনি নিজের বয়সের থেকে বড় ফুটবলারদের বিপক্ষে নিজের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পান।

খুব অল্প বয়সেই সবার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন পাতো। কারণ তিনি তাঁর খেলার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতাকে প্রমান করেছিলেন। তাঁর গতি এবং মাঠের মধ্যের তৎপরতা তাঁকে বেশ টেকনিক্যালি সঠিক একজন ফুটবলারে পরিণত করেছিল। এই ভাবেই সে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হবার যোগ্য তিনি। শারীরিক ভাবে বেশ হালকা পাতলা হওয়ায় বেশ দ্রুত দৌড়াতে পারতেন তিনি। আর এই কারণেই যেকোনো পরিস্থিতিতে একজন বিপদজনক স্ট্রাইকার হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন।

এই ধরনের প্রতিভাবান ফুটবলাররা অতি দ্রুতই ইউরোপে পাড়ি জমান। পাতোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নাই। তিনিও বেশ দ্রুতই সাবেক ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন এসি মিলানে পাড়ি জমান। তাকে দলে ভেড়াতে ২৪ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছিল ইউরোপিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান। কিন্তু ২০০৮ সালে জানুয়ারী ট্রান্সফার উইন্ডো শুরু না হওয়ায় ২০০৮ সালের জানুয়ারীর আগ পর্যন্ত এসি মিলানের হয়ে খেলতে পারেননি তিনি।

জানুয়ারি,২০০৮ সালে পাতোর নতুন যাত্রা শুরু হয়। নতুন ক্লাব, নতুন পরিবেশ, নতুন সংস্কৃতি। নেপোলির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক ঘটে পাতোর। সেই ম্যাচে ৫-২ গোলে জয় পায় এসি মিলান। আর সেই ম্যাচে এক গোল করেন পাতো। এসি মিলানের হয়ে প্রথম মৌসুমে ১৬ ম্যাচে করেন ৯ গোল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লিগে পঞ্চম স্থান অধিকার করে এসি মিলান। এমন কি চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং কোপা ইতালিয়াতে শেষ ১৬ তেই বাদ পড়ে যায় এসি মিলান। সব ফুটবলারদের খারাপ পারফর্মেন্সের মধ্যেও নিজেকে বেশ ভালো ভাবেই অন্যান্যদের থেকে আলাদা করেছিলেন পাতো।

পাতোর বয়স যখন মাত্র ১৯ বছর ঠিক তখনই নিজের ক্যারিয়ায়ে প্রথমবারের মত ইতালিতে পুরো মৌসুম খেলেন। প্রথম মৌসুমে গোল করেন ১৮ টি। এসি মিলানে তাঁর পাশেই খেলছিলো এসি মিলান ক্যারিয়ার শেষ করা পাওলো মালদিনি এবং কাকা। যদিও কাকা পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আবারও এসি মিলানে ফিরে এসেছিল। তাদের পাশে থেকে পাতোর একটি সঠিক উন্নতি হচ্ছিল। ২০১১-১২ মৌসুমে এসি মিলান তারকা পিপ্পো ইনজাগি অবসর নেয়ার পর পাতোকে তুলে দেয়া ৯ নাম্বার জার্সি। ধারণা করা হয়েছিল তিনি সঠিকভাবে ইনজাগির অবস্থান পরিপূর্ন করতে পারবেন।

কিন্তু ইনজাগি ক্লাব ছাড়ার আগের মৌসুম থেকেই ইনজুরির কবলে পড়তে শুরু করেন পাতো। ইনজুরির কারনে মৌসুমের ছয় সপ্তাহ মাঠের বাইরে ছিলেন পাতো। এই মৌসুমে মাত্র ১৮ ম্যাচ খেলতে পেরেছেন এসি মিলানের হয়। ২০১১-১২ মৌসুম ছিল পাতোর জন্য এসি মিলানের শেষ মৌসুম। এই মৌসুমে ইনজুরির কারণে মাত্র সাত ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন। এরপর পাতোকে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব করিন্থিয়াসের কাছে বিক্রি করে দেয় এসি মিলান। তাঁর জায়গায় দলে ভিড়ায় ইতালিয়ান ব্যাড বয় খ্যাত মারিও বাল্লোতেল্লিকে।

তাঁর জন্য দেশে ফিরে আসা ছিল একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ ইতালিতে থাকা অবস্থায় তিনি বেশ কয়েক বার পায়ের পেশির ইনজুরিতে মাঠের বাইরে ছিলেন। দেশে ফিরে ২৪ বছর বয়সী পাতো নিজেকে আবারও প্রমান করতে পারবেন এই আশা ছিল সবার। কিন্তু পাতো তার ভালো সময়কে পিছনে ফেলে রেখে এসেছিলেন। করিন্থিয়াসের হয়ে অভিষেক ম্যাচে গোল করেছিলেন তিনি। তবে পরবর্তীতে নিজের সেই পুরোনো অবস্থাতেই ফিরে যান পাতো। করিন্থিয়াসকে সমর্থকদের থেকে চাপে পড়তে হয় তাঁকে ১৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কেনার জন্য।

জিওয়াসের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান লিগে দুই গোল মিস করার পর করিন্থিয়াস সমর্থকদের রোষানলে পড়েন পাতো। তখনকার সময়ে করিন্থিয়াস এবং বর্তমান ব্রাজিলিয়ান কোচ তিতে বলেন,”এই চাপ টা আসছে তাঁর অতিরিক্ত ট্রান্সফ্র ফির কারণে। ফুটবল শুধু অর্থের খেলা না। যদি ফুটবল অর্থের খেলা হত তাহলে আমরা গত মৌসুমে কোপা লিবার্দোস কাপ জিততে পারতাম না।”

করিন্থিয়াসের সবচেয়ে বড় সমর্থক গোষ্ঠী ফিয়েলের কাছ থেকে বেশ চাপ পাচ্ছিলেন আলেকজান্দ্রো পাতো। ক্রুজেইরোর বিপক্ষে দুইটি উজ্জ্বল গোল করার সম্ভাবনা মিস করেন তিনি। এরপর থেকেই চাপের পরিমান বাড়তে থাকে তাঁর উপর। পাতো তাঁর  করিন্থিয়াস ক্যারিয়ারে কফিনে শেষ পেরেক ঢুকান কোপা ডি ব্রাজিল টুর্নামেন্টে গ্রেমিও বিপক্ষে ম্যাচে। এই ম্যাচে প্যানকেকা পেনাল্টি শট নেন তিনি। এই শট নিতে যে ধরনের শক্তির প্রয়োজন তা তিনি দিতে পারেননি। আর এই ফলেই তার সাবেক মিলান সতীর্থ দিদা সহজেই পেনাল্টি আটকিয়ে ফেলেন। এরপর আর করিন্থিয়াসে থাকতে পারেননি পাতো।

এরপর লোনে খেলেন চেলসি এবং সাও পাওলোতে। এর মধ্যে সাও পাওলো বেশ ভালো করেছিলেন পাতো। সাও পাওলোর হয়ে খেলেছিলেন ৯৮ ম্যাচ। আর গোল করেছিলেন ৩৮ টি। চেলসিতে পাড়ি জমানোর জন্য সাও পাওলোর সমর্থকরা বেশ হতাশ ছিল। ইংলিশ দল চেলসি রাদামেল ফ্যালকাওকে দলে ভিড়াতে না পেরে ইনজুরি প্রবণ ফুটবলার ডিয়াগো কস্তার স্থলে একজন ফুটবলারকে খুঁজেছিল। আর এর জন্যই দলে নিয়ে আসে আলেকজান্দ্রো পাতোকে। চেলসিতে এসে পুরো মৌসুমের জন্য ম্যাচ ফিট থাকতে পারেননি তিনি। মৌসুমে মাত্র দুই ম্যাচ খেলে বিদায় জানান চেলসিকে।

চেলসি অধ্যায় শেষ করে মাত্র তিন মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন ভিলা রিয়ালে। ব্রাজিল, ইতালির পর এখানেও এসে ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারেননি তিনি। পাতোর আগেও ডিয়াগো ফোরলান, আর্জেন্টাইন রিকুয়েলেমের মত ফুটবলাররা নিজেদের ক্যারিয়ারের পুর্নজন্ম ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু পাতো আর সেটা করে উঠতে পারেননি। ভিলা রিয়ালের তারকা স্ট্রাইকার রবার্তো সালদাদো ইনজুরির কারণে ভিলা রিয়াল এনেছিলো দুই প্রতিভাবান স্ট্রাইকার পাতো এবং নিকোলা সানসোনকে। কিন্তু তারা কোনো ধরনেরই পারফর্ম করতে পারেননি। এক মৌসুমেই ভিলা রিয়াল অধ্যায় শেষ হয় পাতোর।

পাতোর জীবন থেকে দেখা যায় সাফল্য পেতে হলে দরকার পরিশ্রমের। কিন্তু সেই পরিশ্রম করতে পারেননি তিনি। ভিলা রিয়াল থেকে পাতো পাড়ি জমান চাইনিজ সুপার লিগে। ১৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে আসেন পাতো। এখানে এসেও পান আকাশচুম্বী বেতন এবং বোনাস। কিন্তু পারফর্মেন্স সেই একই। ভিলা রিয়াল ভেবেছিল হয়তো এখানে এসে তার ক্যারিয়ারের পুর্নজন্ম ঘটবে, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

এরপর আর কখনোই এই রকম সুযোগ পাননি পাতো। ইনজুরি এবং মাঠের বাইরের কারণে অকালেই হারিয়ে গেছেন। মাঠের বাইরের উচ্ছৃঙ্খল জীবন এবং পার্টি তাঁকে ইনজুরিতে পড়তে সাহায্য করেছিল। এছাড়াও এসি মিলানে থাকাকালীন সময়ে তৎকালীন এসি মিলানের মালিক কার্লোস বেরকুসলোনির মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল তাঁর।

সেই সুযোগে বেশ অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতেন পাতো। আর ট্রেনিংয়েও বেশ অমনোযোগী ছিলেন। যখন বেরকুসলোনির মেয়ের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, ঠিক এর পরের ট্রান্সফার উইন্ডোতে তাঁকে বিক্রি করে দেয় এসি মিলান। এরপর আর কখনোই  নিজের সেই পুরাতন ফর্মে ফিরতে পারেননি।

হয়ে রইলেন মহাকাশের উল্কার মত।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link