স্পিন সাম্রাজ্যের পতন!

কেভিন পিটারসেন আসলেই অবসাদগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সফরে এসে গাঁদা গাঁদা বাহাতি স্পিনার দেখতে দেখতে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। এমনিতেই পারতেন না ভালো বাহাতি স্পিন খেলতে। তারওপর এই দলটায় তখন তিন জন ত্রাস বাহাতি স্পিনার-মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান।

এমনকি নেটে গিয়েও দেখেন, সেখানে স্পিনারের ছড়াছড়ি; সব বাহাতি স্পিনার।

ক্লান্ত কেপি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ! আমি যখন খেলতাম, ভয়াবহ একটা জায়গা ছিলো। আমি বাহাতি স্পিন খেলতে পারতাম না এবং এই দেশে প্রতিটা মানুষ বাহাতি স্পিনার। বিমানে ওঠার পর আপনার মনে হবে, পাইলট বাহাতে ঘোরাচ্ছে। রাস্তায় ঘুরতে থাকা লোকগুলোও বাহাতে স্পিন করতে পারে। আমার কাছে, বাংলাদেশ মানে, বাহাতি স্পিনের স্বর্গ। এই দেশের সব ফুরিয়ে যেতে পারে, বাহাতি স্পিনার ফুরাবে না।’

হায়, কেভিন পিটারসেন!

 

এই ২০২০ সালে আপনি আরেকবার বাংলাদেশে এলে বিষ্ময়ে আপনার চোখ বড় বড় হয়ে যেতো। সেই বাহাতি স্পিনারদের স্বর্গে অবশিষ্ট নেই বাহাতি স্পিনার! বাহাতি বাদ দিন, স্পিনারই এখন খুজে পাওয়া কঠিন বাংলাদেশ নামের এক সময়ের স্পিন খনিতে!

বাংলাদেশ শুরু থেকেই উপমহাদেশের ঐতিহ্যমতোই স্পিনার তৈরী করে আসছে। কিন্তু ২০০৬-০৭ সালের দিক থেকে বাংলাদেশে বিশ্বে এক বিষ্ময়ে পরিণত হলো। এই দেশটি হয়ে উঠলো বাহাতি স্পিনারদের এক দূর্গ। বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপের সময় লোকেরা খেয়াল করলো এই দলটি একাদশে তিন জন ফ্রন্ট লাইন বাহাতি স্পিনার খেলাচ্ছে!

রফিক, রাজ্জাক ও সাকিবের সেই ত্রয়ীকে নিয়ে কম কাব্য হয়নি।

এনামুল হক মনি ও মোহাম্মদ রফিক একটা যুগে অদল বদল করে খেলতেন। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মানজারুল ইসলাম রানাও ছিলেন। কারণ তখন তিন বাহাতি স্পিনার একসাথে নামানোর সাহস পেতো না বাংলাদেশ। কিন্তু রফিক, রাজ্জাক, সাকিব এমন ভয়াবহ হয়ে উঠলেন যে, এদের কাউকে বাইরে রাখার উপায় ছিলো না; বিশেষ করে সাকিব অলরাউন্ডার হওয়াতে বাংলাদেশ আরামসে দলটাও সাজাতে পারছিলো।

এই তিন জনের অবদানটা আপনি বুঝতে পারবেন পরিসংখ্যানে। রফিক বাংলাদেশের ওয়ানডেতে প্রথম শত উইকেট শিকারী। রাজ্জাক ও সাকিব দুই শতাধিক উইকেটের মালিক। রফিক অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে অবসর নিয়ে ফেললেন। তারপরও স্পিনধারা শুকায়নি।

রাজ্জাক-সাকিবের সাথে আরাফাত সানি, ইলিয়াস সানি, মোশারফ হোসেন রুবেল পালাক্রমে যুক্ত হতে শুরু করলেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো না কোনো কম্বিনেশনে তিন স্পিনার খেলিয়ে গেছে। লংগার ভার্শনে এর সাথে তাইজুল যুক্ত হলেন এসে ২০১৪ সালে। এর আগে সেই দায়িত্বটা দারুনভাবে সামলেছেন এনামুল হক জুনিয়র।

কিন্তু গত তিন বছর যেনো হঠাৎ এই বাহাতি স্পিনাররা হারিয়ে গেছেন দৃশ্যপট থেকে।

একটা পরিসংখ্যান জানুন: ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ দলে কেবল সাকিব আল হাসান ৪০টি ম্যাচ খেলেছেন। এ ছাড়া কোনো বাহাতি স্পিনার ৫টির বেশী ম্যাচ খেলেননি। বুঝতেই পারছেন, কেমন শুকিয়ে গেছে স্রোত।

কিন্তু কেনো? কেনো হঠাৎ এভাবে বাংলাদেশের মূল শক্তিটা হারিয়ে গেলো?

আমরা আলাপ করেছিলাম বিশেষজ্ঞ স্পিন কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এবং এক সময়ের প্রতাপশালী বাহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। দু জনই হতাশ বর্তমান অবস্থায়। দু জনই বেশ কিছু কারণ বললেন। তবে একটা কারণ খুব জোরের সাথে উল্লেখ করলেন-কোয়ালিটির অভাব।

সালাউদ্দিন বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করলেন। উইকেট বদলে যাওয়া, ব্যাটসম্যানদের উন্নতি এবং নতুন ওয়ানডে আইনের কথা বললেন তিনি, ‘আমাদের স্পিনাররা তো উইকেটের খুব হেল্প নিতো। সেই উইকেট এখন অনেকটাই স্পোর্টিং হচ্ছে। ফলে বাড়তি হেল্প থাকছে না। এরপর বলবো, ব্যাটসম্যানদের কথা। বছরের পর বছর এদের খেলতে খেলতে আমাদের ব্যাটসম্যানদের একটা দক্ষতা তৈরী হয়ে গেছে। এরপর নতুন ওয়ানডে আইনে আপনি ১০ ওভারের পর বাইরে চার জনের বেশী ফিল্ডার রাখতে পারছেন না। এই তিন মিলিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক কম ইফেক্টিভ হয়ে গেছে বাহাতি স্পিনাররা। আর ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম করতে না পারলে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট পর্যন্ত আসবে কি করে?’

এসব বলে অবশ্য সালাউদ্দিন নিজেই আসলে তৈরী হওয়া প্রশ্নটার জবাব দিলেন, ‘আসলে কী, কোয়ালিটটা একটা ব্যাপার। রাজ্জাক, রফিক ভাই, সাকিবকেও তো বছরের পর বছর সবাই খেলেছে। ওরা তো এরকম এক্সপোজ হয়ে যায়নি। ওরা যে কোনো কন্ডিশনেই উইকেট তুলে নিয়েছে। সেই কোয়ালিটিটার অভাব হচ্ছে। কোয়ালিটি থাকলে পরিস্থিতি যাই হোক, স্পিনার বেরিয়ে আসতো।’

 

রাজ্জাক একেবারে প্রশ্নটা শুনেই এক বাক্যে এই উত্তর দিলেন। বললেন, ‘কোয়ালিটি। আমি মনে করি, নিশ্চয়ই সমস্যাটা কোয়ালিটিতে। আমরা তো স্রেফ বাহাতে স্পিন করি, এই নামের কারণে কেউ দলে নিতো না। আমাদেরকে ফাইট করতে হয়েছে। অন্যান্য খেলোয়াড়দের সাথে কোয়ালিটি দিয়ে ফাইট করে দলে আসতে হয়েছে। আমি কারোর দিকে আঙুল তুলবো না। তবে কথা হচ্ছে, আপনার কোয়ালিটি থাকলে অবশ্যই সারভাইভ করতে পারবেন। নিশ্চয়ই সেখানে অভাব হচ্ছে।’

আমরাও মানছি যে, কোয়ালিটি না থাকলে জোর করে টেনে তোলা যাবে না। কিন্তু কোয়ালিটি বাড়ানোর জন্য কী কিছু করছি আমরা?

ঠিক উত্তরটা পাওয়া গেলো না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link