নন্দনকাননের অগ্নিগর্ভ গ্যালারি ও কাম্বলির কান্না

এই বিতর্কটার রেশ কিন্তু পরে ডালমিয়াই ধামাচাপা দিয়ে দেন। এত বড় ব্যাপার নিয়ে বিসিসিআই প্রায় কোনওরকম তদন্তই করেনি তখন। যদিও আজ থেকে প্রায় ২৭ বছর আগের ঘটনায় বিনোদ কাম্বলি এখনও বলে চলেছেন ম্যাচে গড়াপেটা হয়েছিল! প্রকৃত সত্যিটা আশা করি একদিন ঠিকই প্রকাশ পাবে।

১৯৯৬ সাল। তখন ভারতের ব্যাটিং বলতে ৯০%ই বোঝাতো কোঁকড়ানো চুলের, গাট্টাগোট্টা (মারাঠিতে যাকে বলে গাটলা), খর্বকায়, ‘শুধু নিজের রেকর্ডের পেছনে ছোটা’ আর ভবিষ্যতে ‘পাকিস্তানের মাটিতে ডিক্লেরেশনের জেরে নিজের নিশ্চিত টেস্ট দ্বিশতরান মিস করে মিথ্যা বলে কান্নাকাটি’ করা এক মুম্বাইকর। অবশিষ্ট ১০% অংশে মিলিয়ে জুলিয়ে থাকতেন সিধু, সঞ্জয় মাঞ্জরেকর, কাম্বলি, আজ়হারউদ্দীন, জাদেজারা।

বোলিং বলতে কুম্বলে আর আধা ফিট ভেঙ্কটপথি রাজু উইকেট তুললে ভাল, নয়ত মার খেয়ে খেয়ে শ্রীনাথ-প্রসাদের বা প্রভাকরের চোয়াল ঝুলে যাওয়ার আগে অবধি বিপক্ষ দয়া করে ভুলচুক করলে তবে কিছু আশা থাকত, নয়ত নয়। আঙ্কোলা দৈবাদেশ পেয়ে ক্রিকেট ছেড়ে রঙিন পর্দার জগতে চলে না গেলে কি হত তা বলা মুশকিল, কারণ তাঁর সঙ্গেই ভারতীয় দলে আরেক মহান বোলার ছিলেন যাঁর যেন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞাই করা ছিল আন্তর্জাতিক ম্যাচে উইকেট না তোলার। তিনি হলেন অফস্পিনার শ্রীযুক্ত আশিস কাপুর, তাই এ ব্যাপারে আর কোনওরকম মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!

সৌরভ-দ্রাবিড়-লক্ষ্মণরা তখনও মঞ্চে উদয় হন নি। শেহবাগ-যুবরাজ-কাইফ-হরভজন-জ়াহির-নেহরারাও তৈরি হচ্ছেন নিয়তির অমোঘ ইশারায়। কোহলী-রোহিত-ধোনী-শামী-অশ্বিনরাও সূদূর ভবিষ্যতের গর্ভে!

ভারতীয় ক্রিকেটের সেই ভয়াবহ মানবসম্পদের আকালের দিনে কি না (দেশের মাটিতে হলেও) ভারত তার আগের ম্যাচেই, যা ছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, তাতে ৫০ ওভারে ২৮৭ রানের তৎকালীন এভারেস্টসম স্কোর খাড়া করল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে! তাও সেই ‘স্বার্থপর’, ‘ব্যক্তিগত রেকর্ডের পেছনে ছোটা’ মুম্বাইকরের তেমন কোন অবদান ছাড়াই! ওপেন করে সিধু (৯৩) ধরে থাকলেন একদিক, মিডল অর্ডারে টুকটাক রান করে দিলেন আজহারউদ্দীন, মাঞ্জরেকর, কাম্বলিরা।

আর ওয়াকার ইউনুসকে বাস্তবিক ওস্তাদের মার দিয়ে অজয় জাদেজা শেষদিকে ঝড় তুলে ২৬ বলে ৪৫ করে ভারতকে নিয়ে গেলেন ৩০০ ছুঁইছুঁই স্কোরে। মনে রাখবেন, তখনও অবধি ভারত সীমিত ওভারের ক্রিকেটে একবারও ৩০০ রান করেনি। ৫০ ওভারে ৩০০ রান তখনকার দিনে বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল পার করার মতই বীভৎস কীর্তি ধরা হত (এখনও ভালো বোলিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত স্কোর, সে যতই ২০ ওভারে মুড়িমুড়কির মত অধুনা ২৫০ হোক না কেন)! পাকিস্তান কিছুটা লড়াই করলেও অতি আগ্রাসী হয়ে বোলার প্রসাদকে উত্তেজিত করে সোহেল নিজের পতন নিজেই ডেকে আনেন।

‘বুড়ো’ জাভেদ মিঁয়াদাদ নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে একদিন ধরে রাখার চেষ্টা করে খেললেও পাকিস্তানকে জেতানোর পক্ষে তা একেবারেই যথেষ্ট ছিল না। বিশাল আস্কিং রেটের সামনে কুম্বলে-প্রসাদদের উইকেট টু উইকেট বোলিংয়ে এক লতিফ ছাড়া মালিক-ইনজামামরা সবাই ব্যর্থ হন। সোহেল-আনোয়ার জুড়ি আউট হতেই সেবারের মত ছিটকে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নদের।

তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। মাধ্যমিক পরীক্ষার সীট পড়ার জন্য স্কুল ছুটি। তারপরেই আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা। সকাল থেকে পড়ি, আর ভারতের খেলা থাকলেই দুপুর থেকে টিভির সামনে। ১৩ই মার্চ ইডেনে ছিল ভারত আর শ্রীলঙ্কার সেমিফাইনাল। খুব মনে আছে তার ঠিক আগেই পাকিস্তানকে ওইভাবে হারিয়ে আসায় ভারতীয় দলের উপর ইডেনের দর্শকদের প্রত্যাশা চরমে ছিল। শ্রীনাথের উজ্জীবিত প্রথম স্পেলে ম্যাচের সূচনাতেই শ্রীলঙ্কার দুই বিধ্বংসী ওপেনার একের পর এক অল্পরানে ফিরে যাওয়ায় ইডেন আরও তেতে ওঠে।

তারপর গুরুসিংঘেও আউট হতে তো দর্শকরা যেন আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে পড়ে। সেই অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কার ইনিংসের ধ্বস আটকান অরবিন্দ ডিসিলভা আর মহানামা। ডিসিলভা করেন ৬৬, আর প্রবল গরমে রিটায়ার করার আগে মহানামার অবদান ছিল ৫৮। নিজেদের নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা ২৫১।

ভালো স্কোর, কিন্তু অজেয় নয়। কিন্তু কেউ আন্দাজও করতে পারেন নি, যে ভারতের ভাগ্যে সেদিন কি শোচনীয় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। রান তাড়া করতে গিয়ে আগের দুই ম্যাচের নায়ক সিধু প্রথমেই আউট। খেলছিলেন শুধুই সেই ‘স্বার্থপর’ ও ‘ভবিষ্যতের মুলতানি’ মুম্বাইকর। যতক্ষণ তিনি আর সঞ্জয় মাঞ্জরেকর উইকেটে ছিলেন, ততক্ষণ পিচে কোন জুজু আছে বলেই মনে হয়নি। ৬৫ রানে সেই ‘খেয়ালী স্বার্থপর’ এক মুহূর্তের ভুলে স্টাম্পড্ হতেই ভারতের ইনিংস তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে। ঘূর্ণি পীচে আতঙ্ক হয়ে ওঠেন জয়াসুরিয়া-মুরালিরা।

পাল্লা দিয়ে স্ট্রোক খেলতে গিয়ে পরপর জঘন্য শটে আউট হন মাঞ্জরেকর, আজ়হারউদ্দীন, জাদেজা, মোঙ্গিয়া, আশিস কাপুররা। শ্রীনাথও রান আউট হতে ভারত ১২০/৮। কাম্বলী ১০ রানে অপরাজিত অবস্থায় প্রথমবার খেলা বন্ধ হয় দর্শকদের গ্যালারি থেকে ধর্মসেনার গায়ে কেউ জলের বোতল ছোঁড়ায়। শ্রীলঙ্কান দল কিন্তু প্রথমে মাঠ ছাড়ে নি, পিচের চারিদিকে বসে অপেক্ষা করেছিল। ম্যাচ রেফারি লয়েড প্রথমবার ভারতীয় অধিনায়ক আজ়হারউদ্দীনকে ডেকে সতর্ক করার পরেও যখন দ্বিতীয়বার খেলা শুরুর সময় গ্যালারিতে আগুন জ্বলতে দেখা গেল, এবং জয়াসুরিয়া এসে তাঁর উপর ছোঁড়া আধলা ইটের টুকরো শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক রণতুঙ্গাকে দেখালেন, এবার তিনি আর অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গেই পুরো দল নিয়ে বেরিয়ে যান। কলকাতা পুলিশ সেদিন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল উন্মত্ত দর্শকদের নিয়ন্ত্রণ করতে।

বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পর মাঠের পরিবেশ সুষ্ঠুভাবে ম্যাচ শেষ করার অনুকূল নয় বিবেচনায় লয়েড শ্রীলঙ্কাকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। যদিও খেলা হলেও ভারতের জন্য যে শোচনীয় পরাজয়ই অপেক্ষা করে ছিল, তা অনস্বীকার্য! নৈতিক জয় শ্রীলঙ্কারই। কাঁদতে কাঁদতে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন বিনোদ কাম্বলি। শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপে প্রথমবার হারানোর জন্য ভারতকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও তিন তিনটে বছর। সেটা অবশ্য হয়েছিল এক বঙ্গসন্তানের অভাবিত কীর্তিতেই, এটুকুই যা সান্ত্বনা।

যাই হোক, একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করার মত। ইডেনে দর্শকদের হামলা এর আগে বা পরেও হয়েছে। ১৯৯৯ সালের এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালীনও যে গন্ডগোল হয়েছিল, সেটা ব্যাখা করতে গিয়ে একটা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যে ১৯৯৬ সালের মত সেদিনেরও দর্শক হামলা যে ব্যাপকাকার নেয়, তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী ছিল প্রেসবক্সের নীচের গ্যালারির বেশকিছু বহিরাগত অবাঙালী দর্শক, যাঁরা কোনওকালেই নিয়মিতভাবে খেলা দেখার লোকজন নন। কলকাতায় ফুর্তি করতে আসা ও ডালমিয়ার কোটায় ইডেনে ঢুকে পড়া কিছু উ-শৃঙ্খল ও হঠাৎ বড়লোকের দল!

১৯৯৬ সালের উইলস বিশ্বকাপের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের লেজার শো এর সময় থেকেই ইডেনের উইকেট নিয়ে একটা কানাঘুষা ছিলই। ভারতীয়দের ব্যাটিংয়ের সময় আচমকা পীচ ঘূর্ণি উইকেট হয়ে ওঠায় অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন যে সেটা আসলে আন্ডার প্রিপেয়ার্ড ছিল। ডালমিয়ার লোকজন না কি সেই কারন থেকে নজর ঘোরাতেই দর্শকদের উত্তেজিত করতে থাকেন।

এটাও লেখা হয়েছিল যে দেশের সব থেকে ধনী ক্রিকেট সংস্থার প্রধান এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে পিচ নিয়ে এই বিতর্কটার রেশ কিন্তু পরে ডালমিয়াই ধামাচাপা দিয়ে দেন। এত বড় ব্যাপার নিয়ে বিসিসিআই প্রায় কোনওরকম তদন্তই করেনি তখন। যদিও আজ থেকে প্রায় ২৭ বছর আগের ঘটনায় বিনোদ কাম্বলি এখনও বলে চলেছেন ম্যাচে গড়াপেটা হয়েছিল! প্রকৃত সত্যিটা আশা করি একদিন ঠিকই প্রকাশ পাবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...