আলি দিয়া: ফুটবলার নাকি ব্লাফমাস্টার!

তিনি একজন ফুটবলার ছিলেন। নাম আলি দিয়া। আসলে লেখার শুরুতে তাঁকে ফুটবলার হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও নেই।

শুধু ফুটবলার নয়, বেশ ‘হাইলি রেট’ও করা হত তাঁকে। তিনি হলেন কিংবদন্তি ফুটবলার জর্জ উইয়াহর কাজিন। লাইব্রেরিয়ায়র জর্জ উইয়াহকে চেনানোর কিছু নেই, ১৯৯৫ সালে ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার ছিলেন এই তারকা। জর্জের সাথে দিয়া এক সাথে খেলতেন পিএসজিতে। আলি সেনেগালের মানুষ, সেখানেই বড় হয়েছেন।

জর্জ চাইলেন, ভাইটিকে বড় কোনো ক্লাবে দেখতে। তিনি কয়েকটা ক্লাবে ফোন করলেন, ওয়েস্ট হ্যাম, রঠারহ্যাম, গিলিংহ্যাম। কেউ কি দলে নেবে তাঁর কাজিনকে?

শেষে জর্জ ফোন করলেন সাউদাম্পটনে। ম্যানেজার গ্রায়েম সোওনেসের সাথে কথা বলো। সোয়ানেস জর্জের কথার ওপর ভরসা রাখলেন, এক মাসের চুক্তিতে দলে নিলেন আলিকে।

জর্জ উইয়াহ

আলিকে আগে কখনোই দেখেননি সোয়ানেস। তাঁর নামও শোনেননি। কিন্তু, যখন স্বয়ং জর্জ উইয়াহ কাউকে সুপারিশ করেন, তখন তো তাঁকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয় যে কেউ।

তো সোওনেসকে কি বলেছিলেন! জর্জ জানা যাক। জর্জ বলেছিলেন, ‘শোনো আমার এক কাজিন আছে। আমার সাথে খেলেছে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনে। জাতীয় দলে ১৩ টা ম্যাচ খেলেছে। খুব ভাল খেলে। ওকে তুমি একটু বাজিয়ে দেখতে পারো।’

আলি চলে আসলেন ইংল্যান্ডে, সাউদাম্পটনে যোগ দিলেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ নভেম্বর তাঁর অভিষেক হল লিডসের বিপক্ষে। ৩২ মিনিটে ম্যাট লি টিসিয়ার ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়লে ডাক আসে ফরোয়ার্ড আলির।

বাকিটা ইতিহাস।

না, কোনো গোলবন্যার দেখা মেলেনি। বরং খুব সাদামাটা একজনের দেখা মেলে, যিনি ঠিক শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবল খেলারই যোগ্যতা রাখেননা। লি টিসিয়ার বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছিল, বরফে মধ্যের মধ্যে বাচ্চা হরিণ দৌঁড়াচ্ছে। ওকে আমার জায়গায় খেলতে দেখাটা খুব লজ্জাজনক ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি সত্যিই ভেবেছিলাম আমাদের হয়ে ও কোনো শিরোপা জিততে এসেছে। সেটা আমার ভুল ছিল। আমিই সেই খেলোয়াড় যার বদলী হয়ে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে খেলোয়াড়টি মাঠে নামে।’

গ্রায়েম সোয়ানেসও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ম্যাচের ৮৫ তম মিনিটে তিনি বাধ্য হয়ে তুলে নেন দিয়াকে। ম্যাচ শেষে সাউদাম্পটন সমর্থকদের বলতে শোনা যায়, ‘আলি দিয়া-য়া-য়া, ইউ আর আ লায়ার!’

আলি দিয়াকে এরপর আর কখনোই সাউদাম্পটনে দেখা যায়নি। এক মাসের চুক্তিতে এসে মাত্র ১৪ দিনেই সাউদাম্পটন তাঁর সাথে চুক্তি বাতিল করে দেয়।

গ্রায়েম সোওনেস

তখনই ঘটনাটা পরিস্কার হয়ে যায়। সাউদাম্পটন ও গ্রায়েম সোয়ানেসের চোখে ধুলা দেওয়া হয়েছে। তাহলে জর্জ উইয়াহর সুপারিশের ব্যাপারটা কি আসলে! জর্জ উইয়াহ’র কাছে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি আলি দিয়াকে চিনিই না। সোয়ানেসকে ফোন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!’

আলি দিয়া এই ব্যাপারে বলেন, ‘আমি জর্জ উইয়াহর বন্ধু নই। তবে, আমি ফুটবলার। জর্জ উইয়াহ আদৌ ফোন দিয়েছিলেন কি না আমার জানা নেই।’

পরে জানা যায়, উইয়াহ নয়, আলির ইউনিভার্সিটির ‘ভাই-ব্রাদার’রা উইয়াহ সেজে ফোন দেয় সোওনেসকে। সেখানেই ধোঁকাটা খান সাউদাম্পটন কোচ।

তাহলে কে এই আলি!

ম্যাট লি টিসিয়ার, সাউদাম্পটন কিংবদন্তি

আলি সত্যিই ফুটবলার ছিলেন। তবে তিনি কখনোই পিএসজিতে খেলেননি। ফ্রান্স ও জার্মানির তৃতীয় বিভাগের কিছু ক্লাবে খেলেছেন। সাউদাম্পটনে আসার আগে ২১ টা মাত্র ম্যাচে গোল করেন মোটে দু’টি।

এমনকি সাউদাম্পটন ‘ছাড়া’ পরও সেই ‘অভিজ্ঞতা’র সুবাদে প্রতিষ্ঠিত কোনো ক্লাব তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়নি। ইংল্যান্ডের ষষ্ঠ টায়ারের অপেশাদার দল গেটসহেডে যোগ দেন। সেখানে অভিষেকে জোড়া গোলও করেন। তবে, তাঁদের হয়েও আটটার বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি আলি।

সোয়ানেস অবশ্য পরে দাবি করেন, তিনি আগেই নাকি বুঝতে পেরেছিলেন যে আলি কোনো ‘জাতের খেলোয়াড়’ নন। তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে পাঁচ মিনিট দেখেই ধরে ফেলতে পারি কেউ ফুটবল পারে কি পারে না। হোক সেটা ফাইভ আ সাইড ম্যাচ। পাঁচ মিনিট দেখেই বুঝেছিলাম, ওকে দিয়ে হবে না। ও একটা যাচ্ছেতাই। তবে, আমাদের দলে তখন পর্যাপ্ত খেলোয়াড় ছিল না।’

এমন একজনকে মূল দলে তাহলে সুযোগ দিতে কেনই বা হল? সোওনেস বলেন, ‘লিডসের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল শনিবার। সেদিন ফরোয়ার্ডদের মধ্যে ফিট ছিল কেবল ম্যাট (লি টিসিয়ার)। কিন্তু, মিনিট বিশেক পর সেটাও আর থাকলো না। তখন আর করাই বা কি ছিল!’

কেউ কেউ আবার দাবি করেন, এতটাও ‘বাজে’ ছিলেন না আলি। ১৯৯৫ সালে ফিনিশ ক্লাব ফিনপা-তে আলির সতীর্থ ছিলেন মিডফিল্ডার সিমো ভালাকারি। তিনি বললেন, ‘যখন ও আসলো, তখন ওর মধ্যে কিছু একটা ছিল। বিশেষ করে ডান পা দিয়ে ও ডিফেন্ডারদের ভেলকি দেখাতে পারতো। তবে, আর কিছু ছিল না। আর দুই সপ্তাহ পর তাও ছিল না। হয়তো খুব বেশি পার্টিতে মজে গিয়েছিল। এক সময় ওকে দেখে মনে হত – ফুটবলটাই যেন ভুলে গিয়েছে।’

এখন আলি দিয়া কোথায় আছে – কারো জানা নেই। যখন তিনি খেলতেন, তখন ইন্টারনেটের জগৎ আজকের মত বিকশিত ছিল না। সেই সুযোগেই তিনি বিভ্রম সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু, আজ তো ইন্টারনেট আছে, সেখানে কোনো ঠাঁই নেই আলির। জানা গেছে আলির ছেলে সাইমন দিয়াও ফুটবল খেলেন।

আর আলি এখন থাকেন লন্ডনে। যদিও, সেটাও ঠিক নিশ্চিত করে বলা যায় না। সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি নাকি এমবিএও করেছেন। সেই ডিগ্রি এখনো শোভা পায় তাঁর ডাকারের বাড়িতে। এই ডিগ্রিটা আসল তো! তাও নিশ্চিত নয়! আসলে আলি দিয়ার কোনো কিছুরই কোনো নিশ্চয়তা নেই!

ফুটবলে হয়তো আর অস্তিত্ব নেই আলির, তবে আলির মত ‘লিজেন্ডারি’ চরিত্রকে কি করে ভুলে ফুটবল! ২০০৭ সালে ‘দ টাইমস’ বিশ্বের সবচেয়ে বাজে ৫০ ফুটবলারের একটা তালিকা করেছিল। সেখানে সবার ওপরে ছিল আলি দিয়ার নাম!

 

 

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link