পেশাদার ফুটবলকে এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলা যায়। এখানে নিখাদ ফুটবলের চেয়ে আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসেবটা বেশিই হয়। আর তাই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের বিনিময়ে ফুটবলারের গায়ের জার্সি বদলে যায়, রাতারাতি পাল্টে যায় ড্রেসিং রুম। তারপরও কিছু ফুটবলার আছেন যারা একই ক্লাবে একটানা দুই-তিন দশক কাটিয়েছেন। ক্লাবের ফুটবলার পরিচয় চাপিয়ে তারা হয়ে উঠেছিলেন একনিষ্ঠ সমর্থক।
ক্লাবের প্রতি এমন ভালোবাসা নি:শর্ত, তাইতো আত্মার টান বিক্রি হয়নি ইউরো কিংবা ডলারের কাছে। এমন খেলোয়াড়দের মাঝে যেমন আছেন লিভারপুল কিংবা স্টিভেন জেরার্ড, এসি মিলানের পাওলো মালদিনি, তেমনি আছেন এ এস রোমার এক কিংবদন্তি – তিনি ফ্রান্সেসকো টট্টি।
ফ্রান্সেসকো টট্টি ইতালির ক্লাব এ এস রোমার মায়ায় এতটাই ডুবে ছিলেন যে, এই ক্লাবকে প্রেমিকার চেয়ে উপরে স্থান দিয়েছিলেন তিনি। টট্টির সরল স্বীকারোক্তি ছিল এমন, ‘আমার যত গার্লফ্রেন্ড আছে আমি তাঁদের সাথে প্রতারণা করেছি, কিন্তু আমি কখনই রোমার সাথে প্রতারণা করব না।’ এই কিংবদন্তির কাছে রোমা একটা ফুটবল ক্লাবের চেয়ে বেশি কিছু ছিল; সম্ভবত, তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল প্রিয় ক্লাব আর শহর।
১৯৭৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইতালির রোম শহরে জন্ম হয়েছিল ছোট্ট এক শিশুর। লরেঞ্জ এবং ফিওরেলা টট্টি দম্পতির ঘরে জন্ম নেয়া এই শিশুর নাম রাখা হয়েছিল ফ্রাঞ্চেস্কো টট্টি। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি, রোমার সাবেক অধিনায়ক জিউসেপ জিয়ান্নিনিকে আদর্শ মেনে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন এই ইতালিয়ান।
মাত্র আট বছর বয়সে স্থানীয় ফর্তিতুদো একাডেমিতে সুযোগ পান ফ্রান্সেসকো টট্টি। এরপর ত্রাস্তেভের এবং লোদিগিয়ানি ক্লাবে খেলেন তিনি ৷ আর এই সময় তাঁর প্রতিভা নজরে আসে স্কাউটদের, ইতালিয়ান পরাশক্তি এসি মিলান প্রস্তাব পাঠায় টট্টির জন্য। কিন্তু কিশোর ছেলেকে বাড়ি থেকে অত দূরে পাঠাতে রাজি হয়নি তাঁর বাবা-মা; এরপর লাজিও যুব একাডেমিও চেষ্টা করেছিল টট্টিকে নিজেদের করে নেয়ার। কিন্তু বিধাতা টট্টির ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন রোমার নাম, তাই শেষ পর্যন্ত ১৩ বছর বয়সে রোমার বয়স ভিত্তিক দলে ডাক পান তিনি।
প্রায় তিন বছর যুব দলগুলোতে কাটানোর পর ১৯৯৩ সালে এএস রোমার মূল দলে জায়গা হয় ফ্রাঞ্চেস্কো টট্টির। ব্রেসিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রথমবারের মত রোমার জার্সিতে মাঠে নামেন তিনি। পরের মৌসুম থেকে নিয়মিত মাঠে নামতে শুরু করেন টট্টি; স্ট্রাইকারের ঠিক পেছনে সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে নিজের প্রতিভার ছাপ রাখতেও ভুল হয়নি তাঁর।
১৯৯৭ সাল ফ্রান্সেসকো টট্টির ক্যারিয়ারে ব্রেক থ্রু নিয়ে এসেছিল। কোচের সাথে দ্বন্দ্ব, পারফরম্যান্সে পতন – সবমিলিয়ে কিছুটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে স্বরূপে আবির্ভূত হতে শুরু করেন এই প্লে-মেকার। কখনো উইং ধরে ড্রিবলিং আর গতির প্রদর্শনী কখনো আবার ডিফেন্স চেরা পাস – টট্টি হয়ে ওঠেন রোমার পরিকল্পনার কেন্দ্র। সেই সাথে ক্লাবটির দশ নম্বর জার্সিও দেয়া হয় তাকে। ১৯৯৮/৯৯ মৌসুমে সিরি এ ইয়াং ফুটবলার অব দ্য ইয়ার পুরস্কার তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের আরেকটি স্বীকৃতি হয়েই আছে ৷
২০০০/০১ মৌসুমে প্রথমবারের মত ইতালিয়ান সিরি ‘এ’ শিরোপা জেতেন ফ্রাঞ্চেস্কো টট্টি। সেই মৌসুমে ১৩ গোল করে এই জয়ে অবদান রেখেছিলেন তিনি। এরপর আর কখনও বড় কোন ট্রফি না জিতলেও ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করেছেন টট্টি। কখনও স্ট্রাইকার, কখনও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বা সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে ঝড় তুলেছিলেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্স লাইনে।
১৯৯৮ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হলেও ক্লাবের মত সেখানে নামের প্রতি ততটা সুবিচার করতে পারেননি ফ্রান্সেসকো টট্টি। তবে আজ্জুরিদের হয়ে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ জয় এই কিংবদন্তির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম মুহূর্ত; সবমিলিয়ে ৫৮ ম্যাচ খেলেছিলেন ইতালি জাতীয় দলে, নয় গোলের পাশাপাশি ২৪টি অ্যাসিস্ট এসেছিল তাঁর পা থেকে। টট্টির মত খেলোয়াড়দের তুলনায় এমন পরিসংখ্যান নিতান্তই সাদামাটা সেটি বোধহয় আর বলে দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
২০১৭ সালের ২৮শে মে ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ফ্রান্সেসকো টট্টি। পায়ের জাদুতে রোম নগরীর রাজা বনে যাওয়া টট্টি বিশ্রাম দেন পা জোড়াকে। আর সেদিন কেঁদে উঠেছিল রোমের সম্রাট টট্টি, কেঁদেছিল ছোট বড় সব ফুটবল ভক্ত। বিদায়ের আগ পর্যন্ত রোমার হয়ে ৩০৭টি গোল এবং ১৯৭টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন এই ফুটবলার।
ফ্রাঞ্চেস্কো টট্টি কখনো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেননি; কখনো ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলেননি। রিয়াল মাদ্রিদের মত দলও তাঁর প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল, তিনি সাড়া দেননি। কিন্তু রোমাকে ছেড়ে, রোম শহর ছেড়ে যাননি এই ফুটবলার; নিজের স্বপ্নকে আলিঙ্গন করেই কাটিয়ে দিয়েছেন পুরো ক্যারিয়ার।
রোমবাসীর কাছে ফ্রান্সেসকো টট্টি ছিলেন মহানায়ক, এখনও সেই পরিচয়ে ধুলো জমেনি। আসলে টট্টির আনুগত্যে ধুলো জমতেই পারে না, আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম পরেও ক্লাবের প্রতি এমন নিঃশর্ত প্রেম মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে। রোম সাম্রাজ্যের এই অধিপতি হয়তো চিরদিনই অম্লান হয়ে থাকবেন ফুটবল ইতিহাসে, স্মরণীয় হয়ে থাকবেন রোম এবং রোমার ইতিহাসে।