কৃষান পাল রোজকার মত ভোরবেলা পরিবারের জন্য দুধ দোয়াচ্ছিলেন। তবে, এটা ঠিক অন্য আর দশটা দিনের মত ছিল না। আগের রাতেই তাঁর ছেলে রাহুল তেওয়াতিয়া হিরো থেকে জিরো বনেছেন। আসলে জিরো থেকে নয়, তিনি হিরো হয়েছেন ‘ভিলেন থেকে। সেটাও আবার মাত্র পাঁচ বলে শারজাহতে মরুঝড়ের নতুন সংস্করণ উপহার দিয়ে।
রাজস্থান রয়্যালস ২২৪ রানের বিরাট এক লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে প্রথমে ১৯ বল খেলে মোটে আট রান তুলতে পেরেছিলেন রাহুল। তবে, এরপরই নামে ঝড়। শেল্ডন কটরেলের এক ওভারে পাঁচ ছক্কা হাঁকিয়ে তিনি কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব দলের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় এক জয় এনে দেন রাজস্থানকে।
ভারতীয় ঘরোয়া ক্রিকেট অঙ্গনে রাহুল তেওয়াতিয়া পরিচিত একটা নাম। তবে, রোববারের সেই রাতের আগে সমর্থকদের মধ্যে তাঁর নামটা একেবারেই অপরিচিত ছিল। আর সেই রাতের পর এখন চাইলেও তাঁকে ভোলা যাবে না।
সিহি’র মত ছোট্ট একটা গ্রামে সেই খবর ছোট হোক কিংবা বড় হোক ছড়িয়ে পরে ভোজভাজির মত। বাবা কৃষান পাল বলেন, ‘আমার ভঅল লাগছে। ও শুরুতে যেভাবে খেলেছে – সেটা ওর আসল খেলা নয়। পরে যেভাবে খেলেছে – সেটাই ওর সত্যিকারের খেলা। রোজ ও ওতো চাপ নিয়ে খেলতে নামে না, যেমনটা সেদিন ছিল। আমরা জানতাম ও চাপটা একবার ভাঙতে পারলেই নিজের সহজাত খেলা চালিয়ে যাবে। আমরা সবাই মিলে খেলা দেখছিলাম। ওর মা আর দাদিও খুব গর্বিত হয়েছে খেলা দেখে।’
হরিয়ানা প্রদেশেরে ফরিদাবাদ জেলার ছোট্ট একটা গ্রাম হল সিহি। সেখানেই অনেক কাল ধরে তেওয়াতিয়াদের বাস। রাহুলে দাদা ছিলেন কৃষক। কখনো কখনো কুস্তিও লড়তেন। দাদা চাইতেন নাতি তাঁর মতই ‘পালোয়ান’ হবে বড় হয়ে।
রাহুলের চাচা ধরমবীর তেওয়াতিয়া ছিলেন হকি খেলোয়াড়। তিনি তার ভাতিজার জন্যও হকির পরিকল্পনা করেন। তবে, নিয়তি, রাহুলের প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর প্রতিভা তাঁকে শৈশব থেকে ক্রিকেটের দিকে নিয়ে যায়।
মাত্র আট বছর বয়সে বাবা কৃষান পাল তাঁকে ফরিদাবাদের বিজয় যাদব ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে দেন। সাবেক ভারতীয় উইকেটরক্ষক বিজয় যাদবই তাঁর প্রথম কোচ। এই কোচের অধীনে হরিয়ানার হয়ে অনূর্ধ্ব ১৯ ও অনূর্ধ্ব ২২ ক্রিকেট খেলেন রাহুল। রাহুল খুব পরিশ্রমী কেউ ছিলেন না। কিন্তু বাবা-চাচার কড়া শাসনে তিনি পালিয়ে যেতে পারতেন না কখনোই।
যাদব বলেন, ‘একদিন ওর পরিবার ওকে মাঠে নিয়ে আসলো। বললো, স্যার ওকে খেলান। এটা আমাদের গ্রামের সম্মানের ব্যাপার। ও ভাল লেগস্পিন করতো, ভাল ব্যাটসম্যান ছিল, ফিল্ডিংটাও ছিল দারুণ। সমস্যা ছিল ওর ফিটনেসে। কারণ, ও ছিল অলস। এটা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার ব্যাপার ছিল। আমি ওকে বলতাম, ফিটনেস নিয়ে জোর না দিলে তুমি জীবনে কিছুই করতে পারবে না। গেল কযেকটা বছরে আইপিএলে ডাক পাওয়ার পর ও সে নিজের ফিটনেস নিয়ে অনেক কাজ করেছে। এখন ও দারুণ করছে।’
রাহুল লেগ স্পিনার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ব্যাটিং প্রতিভা বিকশিত হয় ধীরে ধরে। উপায়ও ছিল না, শুধু স্পিন দিয়ে হরিয়ানার রঞ্জি দলে ডাক পাওয়াটা তো আর ছেলের হাতের মোয়া নয়। ভারতীয় জাতীয় দলে খেলা দুই লেগ স্পিনার যুজবেন্দ্র চাহাল আর অমিত মিশ্র দু’জনই আছেন। কোচের পরামর্শেই তাই ব্যাটিংয়েও জোর দেন তিনি।
কোচ যাদব বলেন, ‘যখনই ও অনুশীলনে আসতো, আমি বলতাম হরিয়ানার রঞ্জি দলে খেলতে হলে তোমাকে ব্যাটিংয়ে জোর দিতেই হবে, কারণ ওই দলে দুইজন গ্রেট লেগ স্পিনার আছেন। আর শর্টার ফরম্যাটে তোমার সুযোগ আরো বেশি হবে, যখন তারা থাকবে না। তাই, আগে যাওয়ার জন্য ব্যাটিংটাই একমাত্র ক্রাইটেরিয়া। আর আইপিএলে এক-দুই ম্যাচে ভাল করলে সবার নজরে আসা যায়। এখন ও নজরে চলে এসেছে। হয়তো ভারতের ‘এ’ দলে ডাক পাবে। কিংবা, বিশ্বকাপের জন্যও তাকে ভাবা হতে পারে, যদি ওর পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা থাকে।’
রাহুল প্রথম নজরে আসেন আরেক রাহুলের। তিনি হলেন স্বয়ং রাহুল দ্রাবিড়। দ্রাবিড় তখন রাজস্থান রয়্যালসের কোচ। কর্ণাটক রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের একটা অনূর্ধ্ব ২২ পর্যায়ের ম্যাচে তিনি হরিয়ানার হয়ে ৯০ রানের মুগ্ধকর একটা ইনিংস খেলেছিলেন। ইনিংসটা দেখেই দ্রাবিড় ডাকেন যাদবকে। বলেন, ‘ওকে বলে রাখবেন আমি ওকে রাজস্থান রয়্যালস দলে নিবো। আর কোথাও যেতে দেবেন না।’
২০১৪ সালের আইপিএলেই তাঁকে দলে নেয় রয়্যালস। কিংস ইলেবেন পাঞ্জাব দলে তিনি যান ২০১৭ সালে। পরের বছর তাঁর গন্তব্য হয় দিল্লী ক্যাপিটালস। কোনোবারই খুব বড় কিছু করতে পারেননি।
এরপর তিনি ফিরে আসেন আবারো সেই রাজস্থান রয়্যালসেই। যাদব বলেন, ‘রাজস্থান রয়্যালস যখন ওকে আবারো নিয়ে আসলো, তখনই লোকে তার ওপর ভরসা করতে শুরু করেছিল। এখন ও নিজে প্রমাণ করলো যে রাজস্থানের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।’
ভারতে ক্রিকেট দিয়ে জীবন পরিবর্তনের অসংখ্য নজীর আছে। তবে, হাসিখুশি রাহুলের মত করে কারো জীবন পাল্টায়নি এর আটে। তাঁর জীবন পাল্টাছে পাঁচটা বলের ব্যবধানে – মুহূর্তের মধ্যে। এটা যে কারো জীবনের জন্যও বড় একটা শিক্ষা। কখনো হাল না ছাড়ার, নিজের সামর্থ্যের ওপর ভরসা রাখার, সুযোগের জন্য অপেক্ষা করার এমন নজীর রোজ রোজ দেখা যায় না।
বিমান কিভাবে ওড়া শুরু করলো, সেটা কোনো ব্যাপার নয়, বিমান কিভাবে মাটিতে অবতরণ করলো সেটাই তো মূখ্য ব্যাপার। রাহুলের বিমান মাটিতে অবতরণ করেছে। এবার নতুন কোনো ফ্লাইটের অপেক্ষা!