এক টেস্টের অনন্ত আক্ষেপ

তিনি হতে পারতেন আরেক গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, হতে পারতেন আরেক মাইকেল ভন। যাকে ভাবা হচ্ছিলো স্কটল্যান্ড ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করবেন, সেই গেভিনের ক্যারিয়ার ভস্মিভূত হলো কিনা এক টেস্টেই। হয়তো হাতটা একটু বেশিই উঁচুতে বাড়িয়েছিলেন! হয়তো নিজের সামর্থ্যের চেয়েও উপরে। নয়তো বাকিরা সুযোগ পেলেন, আর এক ম্যাচেই কিনা গেভিনের সামর্থ্যের প্রমাণ হয়ে গেলো? দূর্ভাগার প্রতিচ্ছবি এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? এক ম্যাচের মূল্য চুকাতে চুকাতে ক্যারিয়ারই পিছে ফেলে দিলেন গেভিন। ক্যারিয়ারে হতাশা আর আক্ষেপ ছাড়া কিছু নিয়ে যেতে পেরেছিলেন কিনা অনেক জানতে ইচ্ছে করে।

২৫ বছর বয়সে এক কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্কটিশ অলরাউন্ডার গেভিন হ্যামিল্টন। তাঁর সামনে একদিকে সুযোগ ছিলো স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের অধিনায়ক হবার, সেই সাথে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগটাও হাতছানি দিচ্ছিলো।

বেছে নিতে হবে যেকোনো একটি পথ! ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার সুযোগ কেউ ফেলতে পারে? স্কটল্যান্ডের হয়ে যা অর্জন করা সম্ভব না, সেটা যে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে আরামসে করা যাবে তা ভেবে ফেলেছিলেন গেভিন।

আর সেই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন স্কটল্যান্ড ছেড়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে। এরপর ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্টে সুযোগ পেলেন গেভিন। ক্যারিয়ারের মোড়টাও ঘুরে যেতে পারতো সেদিন থেকেই।

ক্রিকেটের সবচেয়ে ঐতিহাসিক আর মর্যাদাপূর্ণ লড়াইটা হলো টেস্ট ক্রিকেট। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মানদণ্ড বলুন আর খেলোয়াড়দের সক্ষমতা যাচাইয়ের সেরা ফরম্যাটটা হলো টেস্ট ক্রিকেট। অবশ্য টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া মানে ম্যাচে আপনার কাছে নিজেকে প্রমাণের জন্য থাকছে দু’টি সুযোগ! প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেকে প্রমাণের জন্য পাওয়া যায় আরেক সুযোগ। যেটা ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টিতে সম্ভব নয়।

ক্রিস অ্যাডামস ও মাইকেল ভনের মাঝে গেভিন, এক সাথে টেস্ট অভিষেক হয় তিনজনের।

ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন স্ট্রোক মেকার গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের কথা যদি বলি, যিনি নিজের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। তবে, দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে খেলেন ১৩৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। পরবর্তীতে সেই বিশ্বনাথই টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রায় ৪২ গড়ে ৬ হাজারেরও বেশি রান করেছিলেন!

অবশ্য বিশ্বনাথের মতো ভাগ্য ক’জনেরই বা হয়। কেউ কেউ অভিষেক ম্যাচের ব্যর্থতায় ক্যারিয়ারই বড় করতে পারেননি। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন গেভিন হ্যামিল্টন। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হন গেভিন! আফ্রিকার সবুজ গালিচায় সাবেক প্রোটিয়া গ্রেট অ্যালান ডোনাল্ডের সামনে দুই ইনিংসেই মুখ থুবড়ে পড়েন গেভিন!

ডোনাল্ডের দুই বলেই শেষ হয়ে তাঁর বহু দিনের স্বপ্ন। ইংল্যান্ডের হয়ে যাত্রাটা শুরু না হতেই শেষ হয়ে যায় গেভিনের। ওই টেস্টে ইংল্যান্ডের ভরাডুবির পরই বাদ পড়েন তিনি। দু:স্বপ্নময় সেই টেস্টের পর ইংল্যান্ড দলে ঢোকার রাস্তাটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় গেভিনের!

শুধু ব্যাট হাতেই নয় ওই টেস্টে বল হাতে ৬৩ রান দিয়েও কোনো উইকেটই নিতে ব্যর্থ হন গেভিন। এমনকি ফিল্ডিংয়েও তালুবন্দী করতে পারেননি কোনো ক্যাচ! সব মিলিয়ে নিজের অভিষেক টেস্টে ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে তিনি ছিলেন শূন্যের বৃত্তে।

সেই সাথে অভিষেক টেস্টেই গেভিন গড়েছিলেন এক লজ্জার রেকর্ড! তিনি টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি টেস্ট ক্যারিয়ারে সুযোগ পেয়েও ব্যাট হাতে না করেছেন কোনো রান, না পেয়েছেন কোনো উইকেট আর না ধরেছেন কোনো ক্যাচ! এমন রেকর্ডে ২২ বছর যাবৎ একক রাজত্ব করছেন গেভিন। সেই বিভিষীকাময় রেকর্ড বইয়ের পাতাটা হয়তো কখনো সুযোগ পেলে পুড়েই ফেলতে চাইবেন গেভিন!

১৯৭৪ সালে স্কটল্যান্ডের ব্রক্সবার্নে জন্ম নেন গেভিন হ্যামিল্টন। যাকে সেসময় ভারতীয় অলরাউন্ডার রবিন সিংয়ের স্কটিশ ভার্সন বলা হতো। লোয়ার মিডল অর্ডারে পিঞ্চ হিটিংয়র পাশাপাশি মিডিয়াম পেস বোলিংয়েও বেশ ভালো ছিলেন গেভিন।

১৯৯৩ সালে ১৯ বছর বয়সে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক। সেসময়ই তাঁকে স্কটল্যান্ডের বেশ সম্ভাবনাময়ী ক্রিকেটার হিসেবে ভাবা হতো। অভিষেকেই ৬৫ রানে শিকার করলেন ৫ উইকেট! বয়সভিত্তিক দলে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখিয়ে সুযোগ পেলেন কাউন্টিতে ইয়োর্কশায়ারের হয়ে খেলার।

১৯৯৪ সালে ইয়র্কশায়ারের হয়ে কাউন্টিতে অভিষিক্ত হন গেভিনের। সেখানে বেশ কয়েক মৌসুমে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে ১৯৯৯ সালে ডাক পান স্কটল্যান্ড জাতীয় দলে! ৯৯ এর ওই বছরই বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের হয়ে মাঠে নামেন তিনি।

ওই বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড ব্যর্থ হলেও দলের হয়ে ব্যাট হাতে উজ্জ্বল ছিলেন গেভিন। পাঁচ ম্যাচে ৪০ গড়ে ২১৭ রান করেছিলেন তিনি! আর ওই টুর্নামেন্টে নিজের সেরা পারফরমটা করেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। ১০ ওভার বোলিং করে ২ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৭৬ রানের ব্রিলিয়ান্ট এক ইনিংস খেলেন তিনি। ওই বছরের শেষেই তাঁর সামনে সুযোগ আসে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার। একই সাথে সুযোগ ছিলো স্কটল্যান্ডের হয়ে অধিনায়কত্বের!

ক্যারিয়ারকে আরো সমৃদ্ধ করতে বেছে নিলেন ইংল্যান্ডের জার্সি। কিন্তু সেই জার্সিই যেনো কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ক্যারিয়ারে। অভিষেকের সেই বিভিষীকা গেভিনের ক্যারিয়ার ওলট পালট করে দেয়। অবশ্য এক ম্যাচ দেখেই কারো সামর্থ্যে বিচার করাটা কখনোই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। যেখানে ওই ম্যাচে পুরো ইংলিশ দলই ছিলো ব্যর্থ। এমনকি ওই ম্যাচে অভিষিক্ত হওয়া আরেক ব্যাটসম্যান মাইকেল ভন দুই ইনিংস মিলিয়ে করেছিলেন মোটে ৩৮ রান! কিন্তু দলের ব্যর্থতার দায়ে কাঁটা পড়েছিলেন গেভিনই!

মাইকেল ভন সুযোগ আর সাপোর্ট দুটোই পেয়েছিলেন দলের কাছে। তাই পরবর্তীতে নিজের ক্যারিয়ারকে নিয়ে গেছেন আরো উঁচুতে। খেলেছেন লম্বা সময়। দীর্ঘসময় ইংল্যান্ডের হয়ে অধিনায়কত্বও করেন!

কিন্তু কোথায় গেভিন হ্যামিল্টন? এতো সম্ভাবনা আর প্রতিভা নিয়ে আসা গেভিনের ক্যারিয়ার যে এক ম্যাচেই নিভে গেলো!

ইংল্যান্ডের হয়ে খেলায় গেভিনকে স্কটল্যান্ড জাতীয় দলে ঢুকতে হলে আবারো ঘরোয়া ক্রিকেটে চার বছর অতিক্রান্ত করে আসতে হতো। একরাশ হতাশা নিয়ে আবারো শুরু করেন গোড়া থেকে। ওই এক টেস্টের কারণেই কিনা তাঁকে শুরু করতে হয় একদম নতুন করে!

চার বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে কাটিয়ে গেভিন ফিরলেন স্কটল্যান্ড জাতীয় দলে। ২০০৪ সালে প্রায় চার বছর পর দলে ফিরে ভালোই করছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে যেই অধিনায়কত্বের দায়িত্ব তিনি না নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে, সেই দায়িত্ব আবারো পান ২০০৯ সালে। ওই বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেন গেভিন।

মাঝে ২০০৭ বিশ্বকাপেও দলের হয়ে খেলেন তিনি। কিন্তু ততোদিনে যে ক্যারিয়ারের একদম শেষে দাঁড়িয়ে তিনি! চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নিকেশটা পার করেছেন আরো আগেই। নতুন করে চাওয়াটা হয়তো ভালো একটা বিদায়?এক বছর দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০১০ সালে ৩৬ বছর বয়সে ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান গেভিন।

তিনি হতে পারতেন আরেক গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, হতে পারতেন আরেক মাইকেল ভন। যাকে ভাবা হচ্ছিলো স্কটল্যান্ড ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করবেন, সেই গেভিনের ক্যারিয়ার ভস্মিভূত হলো কিনা এক টেস্টেই। হয়তো হাতটা একটু বেশিই উঁচুতে বাড়িয়েছিলেন! হয়তো নিজের সামর্থ্যের চেয়েও উপরে। নয়তো বাকিরা সুযোগ পেলেন আর এক ম্যাচেই কিনা গেভিনের সামর্থ্যের প্রমাণ হয়ে গেলো? দূর্ভাগার প্রতিচ্ছবি এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? এক ম্যাচের মূল্য চুকাতে চুকাতে ক্যারিয়ারই পিছে ফেলে দিলেন গেভিন। ক্যারিয়ারে হতাশা আর আক্ষেপ ছাড়া কিছু নিয়ে যেতে পেরেছিলেন কিনা জানতে অনেক ইচ্ছে করে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...