লিমিটেড ওভার স্পেশালিস্ট

তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের লিমিটেড ওভার স্পেশালিষ্ট। ১২১ ওয়ানডেতে ১১৩ উইকেট আর ৩.৭৬ ইকোনমিক রেটের পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে বল হাতে তাঁর কার্যকারিতার কথা।

‘উইকেট টেকিং’ নয়, তিনি ছিলেন একজন ‘কন্টেইনিং’ বোলার। যার কাজ ছিল মিডল ওভারে (১৫-৪০ ওভার) কন্টেইনমেন্ট অর্থাৎ রান আটকে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা। বলছিলাম নব্বইয়ের দশকে বহুল আলোচিত ডিবলি-ডবলি কোয়ার্টেটের অপরিহার্য সদস্য, নিউজিল্যান্ডের সাবেক ডানহাতি স্লো মিডিয়াম বোলার গ্যাভিন লারসেনের কথা।

১৯৬২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে জন্মেছিলেন তিনি। ব্ল্যাক ক্যাপসদের জার্সি গায়ে তিনটি বিশ্বকাপ (৯২, ৯৬, ৯৯) খেলা লারসেনের ডাকনাম ছিল ‘পোস্টম্যান’। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, নিয়মানুবর্তী, নিষ্ঠাবান এবং আত্মনিবেদিত ছিলেন বলে সতীর্থরা তাঁকে এই নামে ডাকতেন।

লারসেনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার স্প্যান হচ্ছে ১৯৯০-১৯৯৯। অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের পুরোটা জুড়েই কিউইদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। গ্যাভিন লারসেনের নামটা সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ১৯৯২ বিশ্বকাপে কিউইদের সারপ্রাইজ প্যাকেজ ডিবলি-ডবলি কোয়ার্টেটের উত্থানের মধ্য দিয়ে। বিখ্যাত এই কোয়ার্টেটের বাকি সদস্যরা হলেন যথাক্রমে ক্রিস হ্যারিস, উইলি ওয়াটসন এবং রড লাথাম।

তাঁদের চারজনকে একসাথে বলা হত ‘ডিবলি-ডবলি-উইবলি-ওবলি’। বলাবাহুল্য, এই নামটা সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ডেভিড লয়েড।

এই চারজনের মধ্যে লারসেন ছিলেন সব চাইতে ইকোনমিক্যাল। গতি কিংবা বাউন্স নয়, তাঁর প্রধান শক্তির জায়গা ছিল অ্যাকুরেসি, কন্ট্রোল ও পেস ভেরিয়েশন। জাস্ট শর্ট অফ আ লেংথে ছোট ছোট সুইং, কাটার আর স্লোয়ারের মিশেলে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করায় ছিলেন দারুণ পারদর্শী। অনেকের মতে, স্লো মিডিয়াম বোলিংকে রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন লারসেন।

লারসেনের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল – ধারাবাহিকতা।

১৯৯২ বিশ্বকাপের ৯ ম্যাচে তাঁর শিকার ছিল ৯ উইকেট, ২৯ গড়ে। প্রায় ৮০ ওভার বোলিং করেও ইকোনমিক রেট ছিল সাড়ে তিনেরও কম (৩.৪৫)! অকল্যান্ডের সেমিফাইনালে দলের বাকি বোলাররা যখন ইনজামামের হাতে বেধড়ক পিটুনি খাচ্ছিলেন, লারসেন ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। ১০ ওভারের স্পেলে একটি উইকেটসহ রান দিয়েছিলেন মাত্র ৩৪!

লারসেনের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং স্পেলটি এসেছিল ১৯৯৪ সালে অকল্যান্ডে, পাকিস্তানের বিপক্ষে। ১০ ওভার বল করে সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম-উল-হকের উইকেটসহ মাত্র ২৪ রানে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। মজার ব্যাপার হল, ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ‘টাই’ হয়েছিল! ওয়াকার ইউনুসের বিধ্বংসী বোলিংয়ে (৬/৩০) শেষ ৭ ওভারে ছয় উইকেট হাতে রেখেও প্রয়োজনীয় ২২ রান তুলতে পারে নি কিউইরা।

১৯৯৬ বিশ্বকাপে মাত্র দুই ম্যাচ খেলে ইনজুরিতে পড়েন লারসেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ রানে জেতা নেইল বাইটারে লারসেনের ইকোনমিকাল স্পেলটাই (১০-১-৩৩-২) ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল। একজন গ্যাভিন লারসেনের প্রকৃত অভাবটা বোঝা গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যেদিন ২৮৬ রান করেও সেটা ডিফেন্ড করতে ব্যর্থ হয় লি জারমনের দল।

১৯৯৯ বিশ্বকাপেও নিউজিল্যান্ডের মত মাঝারি মানের একটা দলকে সেমিফাইনালে তুলতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল লারসেনের মিতব্যয়ী স্লো মিডিয়াম বোলিং। ৯ ম্যাচ খেলে মাত্র ৬ উইকেট নিলেও ইকোনমিক রেট ছিল ৩.৪৬! উল্লেখ্য, বিশ্বকাপের পরপরই সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন তিনি।

ওয়ানডের পাশাপাশি অনিয়মিতভাবে কয়েকটি টেস্টও খেলেছেন লারসেন। কিন্তু সাদা পোশাকের ক্রিকেটে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেন নি। ইকোনমিক রেট ২.১ হলেও ১০ টেস্টে উইকেট পেয়েছেন মাত্র ২৪টা। কিন্তু তাতে কি? ব্ল্যাক ক্যাপস সমর্থকদের হৃদয়ে গ্যাভিন লারসেন একজন ওয়ানডে কিংবদন্তি হিসেবেই চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link