অঙ্কুরে ঝরে পড়া বিরল প্রতিভা

পন্টের কোচিং ম্যানুয়েলের মডেল দু’জন- ওয়াকার ইউনুস ও গোলাম কিবরিয়া আশিক। এই দুইজনের ছবি একই ফ্রেমে বেঁধে নিজের কাছে এখনো রেখে দিয়েছেন পন্ট। পৃথিবীর যেখানেই কোচিং করাতে যান সেখানেই এটি সঙ্গে করে নিয়ে যান তিনি এবং ছাত্রদের এই দু’জনের বোলিং অ্যাকশন দেখানোর পাশাপাশি ছবি দেখিয়ে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন। নিশ্চয়ই আশিকের জীবনে এটি অন্যতম সেরা অর্জন।

ছেলে হতে চায় ক্রিকেটার। কিন্তু বাবার স্বপ্ন লেখাপড়া করে ছেলে উচ্চশিক্ষিত হবে। একটি ভালো মাইনের চাকরি করে দরিদ্র সংসারের হাল ধরবে। দারিদ্রতার বাধা টপকে সংসারের বেহাল অবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে মা-বাবার দুঃখ কষ্ট লাঘব করবে। কিন্তু ক্রিকেটার হবার লক্ষ্যে ছেলে অনঢ়, অটল ও অবিচল। তাই নিজের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে ২০০২ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন নেত্রকোনার সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আশিক।

পরীক্ষায় যথারীতি পাসও করেন তিনি। তবে বিকেএসপিতে ভর্তির খরচ জোগাড় করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় তাঁর পরিবারকে। কিন্তু কী আর করার! ছেলের ইচ্ছা তো পূরণ করতেই হবে। তাই ছেলের খুশির জন্য নিজের কানের সোনার দুল বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে আশিককে বিকেএসপিতে ভর্তি করান তাঁর মা।

সেদিন থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটা আরো বেশি করে দেখতে শুরু করেন গোলাম কিবরিয়া আশিক। স্বপ্ন সার্থক করার পথে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পান তিনি। দলে জায়গা পেলেও সিরিজে নিজেদের প্রথম তিন ম্যাচে একাদশে ঠাঁই হয়নি তাঁর। তারপর চতুর্থ ম্যাচে এসে ভারতের বিপক্ষে কাঙ্ক্ষিত অভিষেকটি হয়ে যায় আশিকের।

তবে ভালো পারফরম্যান্স করে অভিষেক ম্যাচটি রাঙ্গাতে পারেননি তিনি। ম্যাচে ৯ ওভার বল করে ৪৬ রান খরচায় পান মাত্র ১টি উইকেট। উইকেটটি ছিল ভারতের ওপেনার শ্রীভাটস গোস্বামীর (১৫)। এই ম্যাচটি ছিল সিরিজের নিয়মরক্ষার ম্যাচ। কারণ এই ম্যাচের আগেই বাংলাদেশ ও ভারতের ফাইনাল খেলার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। আর সেই ফাইনাল ম্যাচেই বল হাতে জ্বলে উঠেন আশিক। ম্যাচের শুরু থেকেই রুবেল হোসেন ও আশিক চেপে ধরেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। এই চাপের মুখে ভারত শুরুতেই হারিয়ে ফেলে ৪ উইকেট। প্রথম স্পেলেই রুবেল তুলে নেন টপাটপ ২টি উইকেট।

প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে মরিয়া ভারত দাঁড়িয়ে যায় সৌরভ তিওয়ারি ব্যাটের ওপর ভর করে। তিনি একাই সেই ম্যাচে করেন ৮৬ রান। বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠা তিওয়ারির মহামূল্যবান উইকেটটি তুলে নেন আশিক। এই উইকেটসহ ম্যাচে ৮.২ ওভার বল করে ৪৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট পান তিনি যা যুব ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর ক্যারিয়ারসেরা বোলিং। আশিকের পাশাপাশি রুবেল হোসেনও তুলে নেন ৩ টি উইকেট। তাদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ভারতের ইনিংস আটকে যায় ১৯৯ রানে। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের চরম ব্যাটিং ব্যর্থতায় ১২৯ রানের বিশাল ব্যবধানে ম্যাচটি হারতে হয় বাংলাদেশকে।

যুব দলের হয়ে শুরুটা ভালো হলেও ক্যারিয়ারে খুব বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি আশিক। অন্যভাবে বলতে গেলে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগটুকু তিনি খুব কমই পেয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে। শ্রীলঙ্কা সফরে ভালো করার কয়েকমাস পর দলের হয়ে পাকিস্তানে সফরে যান আশিক। সেখানে প্রথম ম্যাচে ৬ ওভারে ৩১ রান খরচায় কোন উইকেট না পাওয়ায় পরের ম্যাচে একাদশ থেকে ছিটকে যান তিনি। এরই সাথে সিরিজের বাকি ৪ ম্যাচও সাইডলাইনে বসে কাটাতে হয় তাকে।

ঠিক এর পরের সিরিজে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দলে ফিরেন তিনি। কিন্তু নিজেকে আর সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। মাত্র ২ ওভার বল করে ১৬ রানের বিনিময়ে কোন উইকেট না পাওয়ায় সিরিজের বাকি ৩ ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি তাঁর। শ্রীলঙ্কা সিরিজের সময় দল থেকে বাদ পড়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত গোটা ত্রিদেশীয় সিরিজ মিস করেন তিনি।

টানা ১১ ম্যাচ মূল একাদশের বাইরে থাকার পর উইন্ডিজের বিপক্ষে ৪ ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচটিতে দলে সুযোগ পান আশিক। এবারের প্রত্যাবর্তনটা অবশ্য বেশ সুখকর হয় তাঁর। ম্যাচে ৬ ওভার বল করে একটি মেইডেনসহ ৩১ রান দিয়ে দুটি উইকেট তুলে নেন তিনি। উইকেটগুলোর মধ্যে একটি ছিল উইন্ডিজের হয়ে সর্বোচ্চ ৫২ রান করা ব্যাটসম্যান শামারাহ ব্রুকসের।

তারপর ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত যুব ক্রিকেট বিশ্বকাপে ১৬ সদস্যের বাংলাদেশ দলে সুযোগ পান আশিক। বিশ্বকাপ শুরুর আগে সর্বশেষ ম্যাচে বল হাতে ভালো পারফরম্যান্স করলেও বিশ্বকাপে দলের প্রথম ম্যাচ থেকেই একাদশে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। প্রথম ম্যাচে বারমুডার বিপক্ষে জিতে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ শুভসূচনা করায় পরের ম্যাচগুলোতে আর উইনিং কম্বিনেশন ভাঙ্গেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। যে কারণে টুর্নামেন্টের অধিকাংশ ম্যাচেই দলের বাইরে থাকতে হয় তাকে।

প্রথম ম্যাচ জিতে বাংলাদেশের যে জয়রথ শুরু হয় তা গিয়ে থামে ৩ ম্যাচ পর দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হারার মাধ্যমে। এ হারের ফলে শিরোপার রেস থেকে ছিটকে যায় বাংলাদেশ যুব দল। তারপর টুর্নামেন্টের শেষদিকে ৫ম স্থান নির্ধারণী ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভাগ্য ফিরে আশিকের। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে খেলতে নামার সেই ম্যাচে যদিও বোলিংটা করা হয়নি তাঁর। বৃষ্টির বাধায় তিনি বোলিং করতে আসার আগেই ম্যাচটি পন্ড হয়ে যায়। আর এটিই  ছিল বাংলাদেশ যুব দলের জার্সি গায়ে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।

বাংলাদেশ যুব দলে ফ্রন্টলাইন পেসার হিসেবে খেলতেন গোলাম কিবরিয়া আশিক। গতিময় বোলিংয়ের জন্য পরিচিত আশিক ঘন্টায় ৮০ মাইল বেগে বল করার পাশাপাশি আউট সুইংটাও ভালো করতে পারতেন। তাঁর বোলিংয়ের ভক্ত ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক বোলিং কোচ এবং সাবেক ইংলিশ পেসার ইয়ান পন্ট।

বিকেএসপিতে পড়াকালীন সময়ে ২০০৫ সালে ভারতের এমআরএফ ফাউন্ডেশনে একবার এক মাসের প্রশিক্ষণে যান আশিক। সেখানে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ইয়ান পন্টের পাশাপাশি ক্ষুদে পেসারদের প্রশিক্ষণ করাতেন অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ডেনিস লিলি। ইয়ান পন্টের অধীনেই সেখানে প্রশিক্ষণ নিতেন আশিক। তখন তাঁর গতিময় বোলিং খুব বেশি মুগ্ধ করেছিল পন্টকে। এতটাই মগ্ধ করেছিল যে সেদিনের পর থেকে পন্ট যেখানেই কোচিং করাতে যান সেখানেই পাকিস্তানের ওয়াকার ইউনুসের পাশাপাশি আশিকের বোলিং অ্যাকশনের ভিডিও ছাত্রদের দেখান।

পন্টের কোচিং ম্যানুয়েলের মডেল দু’জন- ওয়াকার ইউনুস ও গোলাম কিবরিয়া আশিক। এই দুইজনের ছবি একই ফ্রেমে বেঁধে নিজের কাছে এখনো রেখে দিয়েছেন পন্ট। পৃথিবীর যেখানেই কোচিং করাতে যান সেখানেই এটি সঙ্গে করে নিয়ে যান তিনি এবং ছাত্রদের এই দু’জনের বোলিং অ্যাকশন দেখানোর পাশাপাশি ছবি দেখিয়ে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন। নিশ্চয়ই আশিকের জীবনে এটি অন্যতম সেরা অর্জন।

২০১০ সালে জাতীয় দলের বোলিং কোচ হয়ে বাংলাদেশে পা রাখেন ইয়ান পন্ট। প্রথমদিন মাঠে এসেই  তিনি সবার আগে খোঁজ করেন আশিকের। আশিক তখন জাতীয় দলের নেটে বল করতেন। পাঁচ বছর পরেও ইয়ান পন্টের মত একজন তাকে মনে রাখবেন সেটা ভাবনায়ও ছিল না তাঁর। ছোটবেলার গুরুকে পেয়ে সেদিন বেশ রোমাঞ্চিত ছিলেন তিনি। তখন জাতীয় দলের পাশাপাশি তাকে নিয়ে নেটে কাজ করেছেন পন্ট।

গোলাম কিবরিয়া আশিক একসময় সম্ভাবনাময় বোলার হিসেবে বিবেচিত হলেও সে সম্ভাবনা পাখা  মেলার আগেই থেমে যায়। ২০০৮ যুব বিশ্বকাপের পর আশিকের মূল লক্ষ্য ছিল জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ২০১১ বিশ্বকাপে অংশ নেয়া। কিন্তু তাঁর এই লক্ষ্য পূরণের পথে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় শারীরিক অসুস্থতা। ২০০৯ সালে দুইবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পুরো বছর খেলা থেকে বিরত থাকতে হয় আশিককে। টাইফয়েডের জীবাণু আক্রমণ করেছিল তাঁর পাকস্থলীতে যা শরীরের বেশিরভাগ পেশিশক্তি শুষে নেয়। এতে তাঁর পেশি নরম হয়ে যায় ফলে বোলিংয়ে গতি অনেকটাই কমে যায়।

গোলাম কিবরিয়া আশিকের ক্রিকেট ক্যারিয়ার মূলত শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। টাইফয়েড কেড়ে নেয় ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন, বাধা হয়ে দাঁড়ায় জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলার লক্ষ্যের সামনে। টাইফয়েডের ফলে তাঁর ক্যারিয়ারে যে ছন্দপতন ঘটে সেখান থেকে আর লড়াইয়ে ফিরতে পারেননি তিনি। জাতীয় দল তো দূরের কথা ঘরোয়া ক্রিকেটে পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যেতে তিনি ব্যর্থ হন।

নিজ বিভাগ বরিশালের হয়ে ২০১০ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একটি ম্যাচ খেলেন আশিক। এটিই দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর প্রথম ও শেষ ম্যাচ। ২০০৭ সালে যুব দলে খেলার সময় আশিক স্বপ্ন দেখতেন একদিন মাশরাফি বিন মুর্তজার মত বোলার হওয়ার। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাঁর সেই স্বপ্ন কবেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...