সালটা ১৯৮৪! আশির দশকটা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুরন্ত ডমিনেশনের দশক। যাঁরা সেই খেলা দেখেননি, তাদের জন্য একমাত্র তুলনা হতে পারে স্টিভের অস্ট্রেলিয়া, যদিও আশির ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল আরো নৃশংস ও আরো ধারাবাহিক আধিপত্যের অধিকারী। এই দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরপর দুবার ইংল্যান্ডকে ‘ব্ল্যাকওয়াশ’ করে।
যাক, ১৯৮৪ সালের সিরিজে আসা যাক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ড ট্যুর করতে এলো। এর আগের দুটো সিরিজও ইংল্যান্ড হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে, তবে কম মার্জিনে। পাঁচ টেস্টের সিরিজের প্রথম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সহজেই জেতে, ইংল্যান্ডকে ইনিংস ও ১৮০ রানের বিরাট ব্যবধানে হারিয়ে। দ্বিতীয় টেস্টে কিন্তু ইংল্যান্ড শুরু থেকেই ভালো লড়াই করতে থাকে।
ক্লাইভ লয়েড টস জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাট করতে পাঠানোর পরে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৪১ রানের গুরুত্বপূর্ণ লিড নিতে সক্ষম হয়। ইংল্যান্ড ইনিংসের হিরো ছিলেন গ্রেম ফাউলার যিনি ১০৬ করেন দলীয় ২৮৬ রানের মধ্যে। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুরন্ত বোথামের সামনে শুরু থেকেই উইকেট হারাতে থাকে এবং ২৪৫ রানে অলআউট হয়ে যায়। বোথাম ১০৩ রানে ৮ উইকেট নেন, যা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম ৫ উইকেট শিকার ( ক্যারিয়ারে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিনবার ইনিংসে ৫ উইকেট নেন)। ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসেও ভালো ব্যাট করে এবং এলান ল্যাম্বের ১১০ এবং ইয়ান বোথামের ৮১ রানে ভর করে লিড ৩০০ পার করে দেয়।
চতুর্থ দিনের খেলা শেষের প্রায় এক ঘন্টা আগে ঘটে ম্যাচের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্ত যা ম্যাচের ফলাফল পরিবর্তন করতে বড় ভূমিকা নেয়। অ্যালান ল্যাম্ব ১০৯ রানে ব্যাট করছিলেন, সঙ্গে ছিলেন ডেরেক প্রিঙ্গল। আম্পায়াররা এই সময়ে কম আলোর জন্য এলান ল্যাম্বকে খেলা চালিয়ে যাবেন কিনা জিজ্ঞেস করেন এবং এলান ল্যাম্ব আম্পায়ারের কম আলোর প্রস্তাব গ্রহণ করে দিনের মতো খেলা শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। বিবিসির ট্রেভর বেইলি কমেন্ট্রিতে বলেন – ‘ব্যাটসম্যানরা এই সময়ে ক্রিজ ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছুক হবেন না!’ অন্যদিকে, টাইমস ম্যাগাজিনের জন উডকক লেখেন ‘ল্যাম্ব ৬ ঘন্টার উপর ব্যাটিং করেছেন, কিন্তু প্রিঙ্গলকে নিয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর গোটা ইনিংসের প্রথম ভুল।’
দর্শকরাও নিজেদের হতাশা প্রকাশ করতে থাকে এবং গোটা সংবাদমাধ্যম একমত হয় যে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের উপরে সেট ব্যাটসম্যান ল্যাম্ব আরো রানের পাহাড় চাপানোর বদলে তাদের প্রকারান্তরে সুবিধে করে দিলেন। লাঞ্চের এক ঘন্টা পর থেকেই লয়েড ব্যাকফুটে ছিলেন এবং মাত্র একটা স্লিপ নিয়ে বোলিং করাচ্ছিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওভার রেট ও কমছিল ক্রমাগত। কম আলোর অজুহাতে খেলা বন্ধ করে ইংল্যান্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থান হাতছাড়া করে দেয়, সেই যুগে যেটা (ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এগিয়ে থাকা) বেশ বিরল ঘটনা ছিল।
পঞ্চম দিন সকালে ল্যাম্ব আর প্রিঙ্গল দ্রুত আউট হয়ে যাবার পরে ইংল্যান্ড অধিনায়ক ডেভিড গাওয়ার ইনিংস সমাপ্তির ঘোষণা করতে বাধ্য হন। বব উইলিস ব্যাট করতে নামেন নি। যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে ৭৮ ওভারে ৩৪২ রানের যে লক্ষ্য ইংল্যান্ড রেখেছিল তা সেই যুগে প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করা হতো। অবশ্য পিচ তখন ব্যাটিং এর উপযোগী ছিল, তেমন কোনো সুইং হচ্ছিল না, তবুও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে মিনিট পিছু এক রানের লক্ষ্য মোটেই সহজ হবে বলে কেউই সম্ভবত ভাবেননি, ড্রই একমাত্র ফলাফল বলে মনে হচ্ছিল।
ইংল্যান্ডের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় প্রথম ইনিংসে বব উইলিস ও ইয়ান বোথামের লম্বা স্পেলজনিত ক্লান্তি, ডেরেক প্রিঙ্গলের আঙুলের চোট ( যা তিনি ল্যারি গোমস এর ক্যাচ ফেলার সময় পান), নীল ফস্টারের ফর্মে না থাকা এবং একমাত্র স্পিনার, জিওফ মিলারের ভেদশক্তির অভাব ( ৩৩ টেস্টে ৬০ উইকেট পেয়েছিলেন তার আগে)।
- ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ওপেনারদ্বয়, গ্রিনিজ ও হেনস নামেন ও প্রথম দুই ওভার মেডেন খেলার পর তাঁরা উইকেটের চারিধারে বেশ কিছু আকর্ষণীয় শট মারা শুরু করেন। হেনস পরে বলেছিলেন যে তাঁরা বলের মেরিট বুঝে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এবং গ্রীনিজকে প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। গ্রিনিজ বলেন – আমাদের ৩৪২ তাড়া করার কোনো প্ল্যান ছিল না, ব্যাপারটা জাস্ট হয়ে গিয়েছিল! গ্রিনিজ আরো বলেন যে, ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় তিনি একটি ক্রনিক পিঠের চোট নিয়ে খেলেছেন এবং তাঁর ব্যাটিং এর সময় প্রচুর ঘামও হতো, যার ফলে ঘাড়ের মাংসপেশির নমনীয়তা কমে যাবার মতো অসুবিধাও হতো। গ্রিনিজ অল্প খোঁড়াচ্ছিলেন, যদিও তার স্ট্রোকপ্লে তাতে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয়নি।
১৫ ওভারে ওপেনিং জুটিতে ৫৭ রান তোলার পরে ডেসমন্ড হেনস ল্যাম্বের আন্ডারআর্ম থ্রো তে রান আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। তারপরে নামেন ল্যারি গোমস। দুজনে লাঞ্চ অবধি অপরাজিত থেকে দলকে ২০ ওভারে ৮২ রানে পৌঁছে দেন। লাঞ্চের অব্যবহিত পরেই প্রিঙ্গল গোমসকে প্রথম স্লিপে ফেলেন এবং তারপরেই যাকে ইংলিশে বলে – ‘অল হেল ব্রোক লুজ!’
লাঞ্চ ও চায়ের বিরতির মধ্যে গ্রিনিজ আর গোমস ২৫ ওভারে ১৩২ রান যোগ করেন যা তৎকালীন ওয়ান ডে ম্যাচের নিরিখেও ভালো রান রেট। গ্রিনিজ দুর্দান্ত কিছু কাট ও ড্রাইভ মারেন। পরবর্তীকালে গ্রিনিজ এই ইনিংস নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন – ‘৫ ঘন্টায় ৩৪০ রান কোনো দলের বিরুদ্ধেই প্ল্যান করে করা যায় না। আমরা কিছুই প্ল্যান করিনি, আমাদের সামনে রানের গতি বাড়ানোর সুযোগ এসেছিল আর আমরা সেটা গ্রহণ করেছিলাম।’
গাওয়ার চা বিরতি অবধি আক্রমণাত্মক ফিল্ড সাজিয়ে বোলিং করাতে থাকেন, দুই স্লিপ ও একটি গালি নিয়ে। গ্রিনিজ ১৩৫ বলে তাঁর সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ও তারপরে বোথাম উইলিসের বলে তাঁকে স্লিপে ড্রপ করেন। কিন্তু ততক্ষনে ম্যাচের ফলাফল হয়তো নির্দিষ্ট হয়েই গিয়েছিল, কেননা পরের দুজন ব্যাটসম্যান ছিলেন ভিভ আর লয়েড! গ্রিনিজ স্বীকার করেছিলেন যে তাঁকে নিজের মতো খেলার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল কেননা তিনি জানতেন পরে এমন সব ব্যাটসম্যান আছেন যাঁরা জয় না হলেও ড্র করার ক্ষমতা অবশ্যই রাখেন। অর্থাৎ ম্যাচ হারের ভ্রুকুটি আর নেই। এইবার ইংল্যান্ড বিপদ বুঝে নিজেদের ওভার রেট কমাতে থাকে, ঠিক যেমন আগেরদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল, কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
চা বিরতির পরে গ্রিনিজ ও গোমস নজিরবিহীনভাবে ব্রিটিশ বোলিংকে তুলোধোনা করতে থাকেন। বোথামের প্রথম ৩ ওভারে ওঠে ২৯ রান! যার মধ্যে গ্রিনিজের স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে একটি ছয় ও ছিল। যখন আর ২০ ওভার বাকি, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য প্রয়োজন আর মাত্র ৪৩ রান। গ্রিনিজ মাত্র ২৩৩ বলে তাঁর ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ফাইন লেগের উপর দিয়ে হুক করে। গোমস ও শেষদিকে দ্রুত রান তোলায় মন দেন। যখন আর মাত্র ২ রান বাকি, বোথাম অফস্পিন শুরু করেন ( মনোজ প্রভাকরকে মনে পড়ছে কারুর?) এবং প্রথম বলেই গোমস জয়ের রান তুলে নেন যার পরে ইংল্যান্ডের জয় দেখতে চাওয়া হতাশ ব্রিটিশ সমর্থকরা মাঠে দলবেঁধে নেমে পড়ে ( যেটা নব্বইয়ের দশকেও কয়েকবার দেখা গেছে, বিশেষ করে ৯৯ বিশ্বকাপে)।
গ্রিনিজ পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন যে আজকের সময়ে দিনে ৪০০ রানও ওঠে, কিন্তু সেই সময়ে একদিনের কমে ৩০০+ তাড়া করে ম্যাচ জেতা অভাবনীয় ছিল!
- শুকনো পরিসংখ্যান
গ্রিনিজ ২৪২ বলে ২১৪* (২৯ x ৪, ২ x ৬) করেন, গোমস করেন ১৪০ বলে ৯২* (১৩ x ৪)। এই জুটি অবিচ্ছিন্ন দ্বিতীয় উইকেটে ২৮৭ রান তোলেন। ক্রিস্টোফার মার্টিন-জেনকিন্স লিখেছিলেন – ‘গ্রিনিজ একজন কুশলী শিল্পীর মতো লর্ডসের ক্যানভাসে নিজের হৃদয় দিয়ে বিভিন্ন রঙের আল্পনা এঁকেছিলেন!’
গোমসের ভূমিকা অনেকে ভুলে গেলেও গ্রিনিজ ভোলেননি, ‘গোমস সেই ইনিংসেও বেশ বিস্ফোরক ছিল। ল্যারি যেভাবে খেলেছে, তার ভূমিকা অনেকেই উপেক্ষা করছেন। আমি যা করেছি তার জন্য আমি যোগ্য সম্মান পেয়েছি… ল্যারিও কিন্তু একটি ব্যতিক্রমী ইনিংস খেলেছে। আমরা যখন তার সেঞ্চুরি করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি, তখন গোমস সে নিয়ে আদৌ ভাবিত ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘চলো খেলা শেষ করা যাক।’ এটা অসাধারণ আত্মত্যাগ ছিল। সেদিন ইতিহাস তৈরি হওয়ার কথা ছিল, এবং আমরা তা করেছিলাম।’
সেই ফাইনালের দিনে যারা মাঠে ছিলেন – তাঁরা যথার্থই সৌভাগ্যবান। নিঃসন্দেহে গ্রিনিজের অসাধারণ ইনিংসটি ম্যান-অফ-দ্য-ম্যাচ পুরস্কার জেতার যোগ্য ছিল। ভিন্নমত ছিল বিচারক গডফ্রে ইভান্সের, যিনি গ্রিনিজ এবং বোথামকে যৌথভাবে এটি দিয়েছিলেন।
- উপসংহার
এরপর ৫-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হেইনস বলেছিলেন – ‘কেউ ব্ল্যাকওয়াশ সম্পর্কে আগে থেকে চিন্তা করেনি, আমি আপনাকে নিশ্চিত বলতে পারি। ৮০-এর দশকে ইংল্যান্ড বারবার যে ভুলটি করেছিল তা হল আমাদের ফাস্ট বোলারদের কার্যকারিতা কমিয়ে দেবার জন্য উইকেট ফ্ল্যাট দেওয়ার চেষ্টা করা, কিন্তু তাতে তাদের নিজেদের বোলারদের পক্ষেই আমাদের দুবার আউট করা কঠিন হয়ে পড়ে।’
গ্রিনিজ ৮১.৭১ গড়ে ৫৭২ রান নিয়ে সেই ট্যুর শেষ করেন। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে চতুর্থ টেস্টে তাঁর আরও একটি ডাবল সেঞ্চুরি – ২২৩ – ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৮৫-৮৬ সালেও নিজেদের দেশে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ ৫-০ জিতেছিল।