রিটায়ার্ড আউট, রিটায়ার্ড হার্ট, রিটায়ার্ড নট আউট, এরকম প্রায় সমার্থক ক্রিকেটীয় শব্দ শোনেননি, এমন কোনো ক্রিকেটপ্রেমী খুঁজে পাওয়া বেশ দুস্কর। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে কেউ কখনো ‘রিটায়ার্ড নট আউট’ হয়েছে, এমন শুনেছেন? কিংবা কতজন রিটায়ার্ড আউট হয়েছেন তার হিসাবটা কি জানা আছে? এ ধরনের ক্রিকেটীয় টার্ম বহুল প্রচলিত হলেও প্রকৃত পক্ষে ক্রিকেট ইতিহাসে রিটায়ার্ড আউট কিংবা নট আউট থাকার ঘটনা কিন্তু খুবই নগণ্য।
ল’জ অব ক্রিকেটের ২৫ নং ল অনুযায়ী কোনো ব্যাটসম্যান আঘাতজনিত বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া স্বেচ্ছায় ব্যাটিং ছেড়ে চলে গেলে তাঁকে ‘রিটায়ার্ড আউট’ ঘোষণা করা হয়। এই আউটের কৃতিত্ব কোনো বোলারের প্রাপ্য নয়। প্রচলিত অর্থে রিটায়ার্ড হার্ট আলাদা মনে হলেও ক্রিকেটীয় আইনে এটাও রিটায়ার্ড আউটের অন্তর্ভূক্ত।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে কোন কারন ছাড়া রিটায়ার্ড আউটের ঘটনা প্রায়শই ঘটলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই আউটের ঘটনা ঘটেছে মাত্র দুবার। একই ম্যাচে একই দিনে ঘটা এই বিরল দৃশ্যের সাক্ষী বাংলাদেশ!
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকা ম্যাচে মারভান আতাপাত্তু (২০১) ও মাহেলা জয়াবর্ধনে (১৫০) স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন সতীর্থদের ব্যাটিং প্র্যাক্টিসের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। স্কোরবোর্ডে তাদের দুজনের নামের পাশে লেখা হয়েছিল ‘রিটায়ার্ড আউট’। অখেলোড়সুলভ আচরণের জন্য এটা নিয়ে বেশ সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সে সময়।
অসুস্থতা, ক্লান্তি কিংবা আঘাতজনিত কারণে অনেক সময় আউট না হয়েও মাঠ থেকে বেরিয়ে যান ব্যাটসম্যানরা। সে ব্যাটসম্যান যদি পরবর্তীতে ব্যাটিং করতে অক্ষম থাকেন তাহলে তাকে ক্রিকেটীয় আইন অনুযায়ী রিটায়ার্ড নট আউট বলে বিবেচিত করা হয়।
ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত রিটায়ার্ড নট আউটের ঘটনা ঘটেছে একবার। যিনি এই প্রথম এবং একমাত্র রিটায়ার্ড নট আউটের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি অবশ্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন এক সময়ে। তিনি বাংলাদেশের ১৯৯৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের অন্যতম পথিকৃত ব্যক্তি ছিলেন। যাহোক পরিচয় বর্ণনা দীর্ঘায়িত না করে বলি, ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম এবং রিটায়ার্ড নট আউট আউট থাকার বিরল রেকর্ড গড়েছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ।
১৯৮৩ সালের আজকের এই দিনে (৩০ এপ্রিল) তিনি অনন্য এ ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮৩ সালে ভারতের বিপক্ষে সে টেস্ট ম্যাচে কোনো আঘাতজনিত কিংবা ক্লান্তির কারণে মাঠ ছাড়েননি গর্ডন গ্রিনিজ। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে মাঠ থেকে চলে গিয়েছিলেনতিনি। তার সেই ‘রিটায়ার্ড নট আউট’ থাকার পিছনে আছে মর্মান্তিক এক ইতিহাস।
অ্যান্টিগায় সিরিজের পঞ্চম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ভারতের করা ৪৫৭ রানের জবাবে ব্যাট করছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। উদ্বোধনী জুটিতে গ্রিনিজ ও হেইন্স মিলে করেছিলেন ২৯৬ রান। হেইন্স ১৩৬ রানে আউট হয়ে গেলেও গ্রিনিজের ইনিংসের সমাপ্তিটা হয়েছিল অত্যন্ত করুণভাবে।
১৫৪ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় গ্রিনিজ খবর পান তার মেয়ে ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় বারবাডোজের একটি হাসপাতালে ভর্তি আছে। দুই বছর বয়সী অসুস্থ মেয়ে রিয়াকে দেখতে গ্রিনিজ সেদিন খেলা ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। কিডনির প্রদাহজনিত অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গ্রিনিজের মেয়ে আর সুস্থ হয়নি; দুদিন পরই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে। সেই ম্যাচের স্কোরকার্ডে গর্ডন গ্রিনিজের নামের পাশে লেখা হয়েছিল ‘রিটায়ার্ড নট আউট’। ক্রিকেট ইতিহাসে রিটায়ার্ড নট আউটের একমাত্র উদাহরণ হিসেবে অমর হয়ে আছে তাঁর নাম।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এরকম মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখযোগ্য আরো একটি নজির রয়েছে। অকাল প্রয়াত অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ফিলিপ হিউজ তার সর্বশেষ ম্যাচে ৬৩ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় শন অ্যাবটের বলে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মাঠ ছাড়েন। তিন দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শেষ পর্যন্ত মারা যান হিউজ।
হিউজের সম্মানে শেফিল্ড শিল্ড ট্রফির সেই প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের স্কোরকার্ড সংশোধন করেছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। হিউজের নামের পাশে থাকা ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ লেখাটি বদলে নতুন করে শুধু ‘নট আউট’ লেখা হয়। সেই ম্যাচের স্কোরকার্ডে আজীবন ফিলিপ হিউজের নামের পাশে ৬৩ নট আউট লেখা থাকবে। হিউজ আহত হওয়ার পরই অবশ্য ম্যাচটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়।