এমন ম্যাচকে ঠিক কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? ঠিক কোন পঙক্তিতে একটা সারাংশে বাঁধা যায়? এভাবেও বুঝি ফিরে আসা যায়! একদম তাই! আইরিশদের জয়ের পথে হঠাৎই বাঘের থাবা বসানো, এরপর পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য, নখ কামড়ানো মুহূর্ত, পরতে পরতে উত্তেজনা, রোমাঞ্চকর মুহূর্ত— সবকিছু পেরিয়ে অবশেষে জয়ের পুষ্পমাল্যটা বাংলাদেশের। শেষ বলের উত্তেজনায় চার রানের জয় পেয়েছে টাইগাররা। আর এর মধ্য দিয়ে ২-০ সিরিজ জিতে নিল বাংলাদেশ।
টসে হেরে এ দিন প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুটা ভালই হয়েছিল টাইগারদের। পাওয়ার প্লে’র প্রথম ১০ ওভারেই ১ উইকেটে স্কোরবোর্ডে তারা জমা করে ৬২ রান।
এমন দারুণ শুরুর পরও অবশ্য দলীয় সংগ্রহ শেষ পর্যন্ত ৩০০ টপকাতে পারেনি বাংলাদেশ। ১৩ রানে শেষ ৫ উইকেট নির্ধারিত ৫০ ওভারের কোটা শেষ হওয়ার আগেই ৪৮.৫ ওভারে ২৭৪ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ।
অথচ দারুণ এক সংগ্রহের পথেই ছিল তামিমের দল। অভিষিক্ত রনি তালুকদার আইরিশ পেসারদের সুইং সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মাত্র ৪ রানেই।
তার আগে ভাগ্যের ছোঁয়ায় বেঁচে যান অধিনায়ক তামিম। জশ লিটলের একটি বলে ব্যাট ছুঁইয়ে সেকেন্ড স্লিপে থাকা অ্যান্ড্রু বলবার্নির হাতে সহজ ক্যাচ তোলেন তামিম। কিন্তু সেটি লুফে নিতে পারেননি আইরিশ অধিনায়ক। আর এতেই সে সুযোগ কাছে লাগিয়ে ৯ ইনিংস পর ওয়ানডে ক্রিকেটে ফিফটির দেখা পান তামিম।
তামিমের ফিফটির পথটা অবশ্য সহজ করে দিয়েছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত আর লিটন দাস। এ দুই ব্যাটার ক্রিজে এসেই রান তুলেছেন দ্রুতগতিতে। তবে কেউ ইনিংস বড় করতে পারেননি। দুজনই ফিরে যান ৩৫ রান করে।
শান্ত, লিটনের পর আগের ম্যাচে ফিফটি পাওয়া তাওহীদ হৃদয়ও এ দিন দারুণ শুরুর আভাস দিয়েছিলেন। তবে তিনিও ইনিংস বড় করতে ব্যর্থ হন। ১৬ বলে ১৩ রান করে জর্জ ডকরেলের বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরে যান হৃদয়।
ফিফটি পূরণ করার পর তামিমও আইরিশ বোলারদের সামনে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যান। অথচ দলের ক্রান্তিলগ্নে তামিমের দিকেই তাকিয়ে ছিল সবাই। তবে শুরুর ছন্দ আর পরবর্তীতে আর ধরে রাখতে পারেননি। এক প্রকার ধৈর্য্যচ্যূতিতেই পতন ঘটে তাঁর।
জর্জ ডকরেলের বল ডাউন দ্য উইকেটে এসে উড়িয়ে মারতে গিয়ে শর্ট থার্ড ম্যানে ক্যাচ তোলেন তামিম। অ্যান্ড্রু বালবার্নির মতো এবার আর ভুল করেননি ক্রেইগ ইয়াং। ফলত, ৮২ বলে ৬৯ রানের ইনিংস খেলে ফিরে যেতে হয় তামিমকে।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে টেনে তোলার দায়িত্বটা নিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম আর মেহেদী হাসান মিরাজ। এ দুই ব্যাটারের ৭২ বলে ৭৫ রানের জুটিতে বড় সংগ্রহের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। তবে বিপত্তিটা ঘটে ৪৬তম ওভারে।
৫৪ বলে ৪৫ রান করা মুশফিক ফিরে গেলে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। সেই চাপ আরো বেড়ে যায় য়খন পরের ওভারে মিরাজ আউট হয়ে ফিরে যান। বাংলাদেশের রান তখন ৭ উইকেটে ২৬৫। এরপর মাত্র ৯ রান যোগ করতেই বাকি ৩ টি উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। একটা সময় পর্যন্ত তিনশোর পথে এগোতে থাকা বাংলাদেশ অলআউট হয় ২৭৪ রানে।
২৭৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতে রয়েশয়েই ব্যাটিং শুরু করেছিলেন আইরিশ দুই ওপেনার স্টিফেন দোহেনি আর পল স্টার্লিং। তবে সেই অতি রক্ষণাত্বল ভঙ্গিরই মাশুল দিতে হয় দোহেনিকে। মুস্তাফিজের বলে স্লিপে লিটন দাসের হাতে ক্যাচ দিয়ে তিনি ফিরে যান ৪ রানে।
তবে দোহেনি ফিরে যাওয়ার পরই দারুণভাবে প্রতিরোধ তোলে আয়ারল্যান্ড। তিনে নামা অ্যান্ড্রু বালবার্নি আর পল স্টার্লিংয়ের জুটিতে জয়ের পথে দুর্দান্ত আগ্রাসনেই এগিয়ে যায় আইরিশরা। এ দুই ব্যাটারের জুটি থেকে আসে ১০৯ রান।
মূলত এ জুটিতেই একটা সময়ে আয়ারল্যান্ডের জন্য ম্যাচ জয় অনেক সহজই মনে হচ্ছিল। তার উপর দুজনই তুলে নেন ব্যক্তিগত অর্ধশতক। তবে দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠা এ জুটিতে ভাঙন ধরান এবাদত হোসেন।
ফিফটি পূরণের কিছুক্ষণ বাদেই স্কোয়ার লেগে উড়িয়ে মারতে গিয়ে রনি তালুকদারের তালুবন্দি হন বালবার্নি। আইরিশ এ অধিনায়ক ফিরে যান ৫৩ রানে। মূলত এরপরেই ম্যাচে ফিরে আসে বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ব্রেক থ্রু টা পায় মেহেদি হাসান মিরাজের সৌজন্য। কারণ তাঁর শিকার হয়েই ব্যক্তিগত ৬০ রানে ব্যাট করতে থাকা পল স্টার্লিং সাজঘর ফিরে যান।
অবশ্য স্টার্লিং ফিরে যাওয়ার পরও হ্যারি টেক্টর আর লরকান টাকারের জুটিতে ম্যাচ থেকে ছিটকেই গিয়েছিল বাংলাদেশ। এ দুই ব্যাটারের ৭৯ রানের জুটিতে দারুণভাবে ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে আয়ারল্যান্ড। কোনোভাবেই এ জুটিতে ভাঙন ধরাতে না পেরে অধিনায়ক তামিম বলে আনেন পার্ট টাইমার শান্তকে।
আর সেই শান্তর কাছেই ধরা দেন ফিফটির পথে এগিয়ে যেতে থাকা হ্যারি টেক্টর। আর এরপরেই কিছু আশা জাগে বাংলাদেশ শিবিরে।
আর সেই আশার পারদ আরো বাড়িয়ে দিতে দৃশ্যপটে হাজির হন মুস্তাফিজুর রহমান। ১১ রানের ব্যবধানে তুলে নেন কার্টিস ক্যাম্ফার আর জর্জ ডকরেলের উইকেট।
ম্যাচ জমে উঠে ঠিক এরপরই। তবে তখনও লরকান টাকার উইকেটে টিকে ছিলেন। বালবার্নি, স্টার্লিংয়ের পর তিনিও তুলে নেন ফিফটি। তবে বাংলাদেশের জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে আশঙ্কার কারণ হতে দেননি মুস্তাফিজ। ফিফটি পূরণের পর স্কুপ করতে গিয়ে মুস্তাফিজের বলে বোল্ড হয়ে ফিরে যান এ ব্যাটার।
আয়ারল্যান্ডের শেষ স্বীকৃত ব্যাটার ফিরে যাওয়ায় ম্যাচ তখন ঝুঁকে গিয়েছে বাংলাদেশের দিকে। তারপরও শেষ দুই ওভারে আইরিশদের ২৪ রানে সমীকরণে ম্যাচ তখন পেন্ডুলামের মতো দুলছিল। এর মাঝে আবার ১৯ তম ওভারে এসে মৃত্যুঞ্জয়ের ওভারে এক ছক্কা আর এক চারে ১৪ রান তুলে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়ার পথে দাঁড়িয়ে ছিলেন মার্ক অ্যাডায়ার।
তবে ইনিংসের শেষ ওভারে আইরিশদের ১০ রানের সমীকরণের সামনে হাসান মাহমুদ এসেই অ্যাডায়ারের উইকেট তুলে নেন। এর এক বল বাদে অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইনকেও স্লোয়ারের ফাঁদে ফেলে আউট করেন হাসান মাহমুদ। তারপরও ম্যাচ গড়ায় শেষ বলের উত্তেজনায়। তবে সে বলে আইরিশদের কাঙ্ক্ষিত সেই ৬ রান আর পাওয়া হয়নি। দুর্দান্ত কামব্যাকে, শেষের স্নায়ু ধরে রেখে জয়টা পায় বাংলাদেশই।