তিনি গান্ধী, তিনি রাহুলও

তাঁর কথা বলতে শুরু করলে গুলিয়ে যাবেই স্থান-কাল-পাত্রের সময়রেখা। দেওয়াল ভেঙে মিলেমিশে যাবে অনুরাগী ও সমালোচকের দল। একইসঙ্গে স্পষ্ট ভাগে ভাগ হয়ে যাবে অনুগামী ও প্রতিগামী শিবির।

এমনিতে তাঁর পুঁজির ভাঁড়া প্রায় শূন্য। কাশ্মীরি রূপের আভিজাত্য বা ধনকৌলিন্য নেই। নেই মুম্বাইয়ের তুঙ্গস্পর্শী প্রতিভা, বাংলার স্বাভাবিক সৌন্দর্য বা হায়দ্রাবাদের খামখেয়ালিপনার ধারাবাহিকতা। তিনি ভাল বক্তা নন, কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়, স্পষ্ট বোঝা যায় না, কী বলছেন। স্বভাব-লাজুক তাঁকে ক্যামেরার সামনে বরাবর আড়ষ্ট লাগে; মনে হয়, তিনি আড়ালেই স্বচ্ছন্দ, জোর করে নিজেকে স্মার্ট দেখাতে গেলে আরোই বেকুব লাগে তাঁকে। উত্তরসূরির মত মেধার ঔজ্জ্বল্য বা পূর্বসূরির মত বাগ্মিতা দুইই তাঁর করায়ত্ব নয়।

তাঁর সিদ্ধান্তগুলোও কেমন যেন স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধির গণ্ডির বাইরে দিয়ে যায়। সারা দেশ যখন তাঁকে অনুসরণ করে সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আন্দোলনে, তিনি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখেই নিজেকে গুটিয়ে নেন। বিনা প্ররোচনায় ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেন। সর্বজনপ্রিয় পারফর্মারকে ছেড়ে হঠাৎ ব্যাক করতে শুরু করেন অজ্ঞাতকুলশীলকে। সমাজে তাঁর কায়েমি স্বার্থ নিয়ে গুঞ্জন ওঠে।

এই সব কিছুর পরেও তিনি এক নতুন সভ্যতার, এক নতুন শৈলীর, এক নতুন বিশ্বাসের ভগীরথ; খুব সাধারণ তাঁর দর্শন – পন্থা ঠিক রাখো, অবিচল থাকো সেই সরণিতে; লক্ষ্য নিয়ে মাথা ঘামিও না। চলার পথ ঠিক থাকলে গন্তব্য আপনা আপনিই এসে যাবে। আর যদি গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য পথ বদলাতে হয়, মনে রেখো, সে গন্তব্যই ভুল!

এই দর্শনে তাঁর বিশ্বাস এত দৃঢ়, এতই অবিচল যে সমসময় এবং ভাবীকাল – দুই বিন্দু থেকেই তাঁকে বারবার একগুঁয়ে, অপরিণামদর্শী বলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে এবং হবে; এবং সেটা করা সব সময় ভুলও হবে না। যে ভ্রান্তি তাঁর নিজস্ব, তার জন্য তো বটেই, এমনকী যে ভুল তিনি করেননি, তার জন্যও তাঁকে রক্তাক্ত হতে হচ্ছে এবং হবে। লোকে বলবে দেশ ভাগের জন্য তিনিই দায়ী, তিনিই দায়ী টুর্নামেন্ট হেরে আসার জন্য! এবং এই আনখশির অন্যায়ের বিরুদ্ধেও তিনি একবারও আওয়াজ তুলবেন না, আত্মপক্ষ সমর্থনে একটিও শব্দ ব্যয় করবেন না!

এত কিছুর পরেও অস্বীকার করা যাবে না, সুরেন বাঁড়ুজ্যে, উমেশ বাঁড়ুজ্যে, মতিলাল প্রভৃতি মুষ্টিমেয় এলিটিস্টের স্বপ্নবিলাসকে তিনিই প্রথম গণআন্দোলনের মার্গদর্শন করিয়েছিলেন। এত কিছুর পরেও অস্বীকার করা যাবে না, ট্যালেন্ট, ফ্ল্যামবয়েন্স বা ঔদ্ধত্য যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, হতাশ করেছে – মধ্যবিত্ত শ্রমিকের মত, গ্ল্যামারহীন ছাপোষা গৃহকর্তার মতো তিনি মাথা গুঁজে, মাটি কামড়ে ঘষটে-ঘষটে পার করে দিয়েছেন বৈতরণী।

এত কিছুর পরেও অস্বীকার করা যাবে না যে তাঁর, একমাত্র তাঁরই ধক ছিল বলার, ‘তুমি আমাকে মেরে আমার মৃতদেহ পেতে পারো, কিন্তু আমার বাধ্যতা পাবে না’; প্রায় নীরব মৃদুভাষী এই তিনিই সুপারস্টারের দ্বিশতরানের পরোয়া না করে টিমের প্রয়োজনকে সর্বাগ্রে রাখার হিম্মত দেখিয়েছেন, এটাই বা স্বীকার না করে যাবেন কোথায়?

এত কিছুর পরেও অস্বীকার করা যাবে না, তাঁর পন্থাকে এই বাইনারি দুনিয়ায়, এই ৩৬০ ডিগ্রি-সূর্যকুমারের দুনিয়ায় একেবারে জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলা যাচ্ছে না; এখনও! আজও! তিনি গান্ধী, আবার তিনি রাহুলও বটে। থ্যাঙ্ক গড, তিনি রাহুল গান্ধী নন!

সময়ে তিনি কিছুই পাননি। তিনি সেই ‘নাইস গাই’ যে কখনও প্রথম স্থান অধিকার করেনি। রাহুল শরদ দ্রাবিড়, ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম মধ্যবিত্ত মিলিওনেয়ার! সুস্থ থাকুন, নিজের পন্থায় অবিচল থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link